রাজশাহীতে পানিতে ভাসছে কৃষকের ফসল, ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা
স্টাফ রিপোর্টার: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে রাজশাহী অঞ্চলে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত দু’দিনের বৃষ্টিতে এই অঞ্চলের হেক্টর-হেক্টর জমির কৃষি আবাদে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ডুবে ভেসে গেছে শত-শত পুকুর।
এর মধ্যে বিশেষ করে গত শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাতভর ভারি বৃষ্টিতে কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় মাঠের ধান, পানবরজ, ভুট্টা, ধান, আলুসহ শীতকালীন রবি শস্যের ক্ষেত জলমগ্ন হয়ে পড়ায় চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন কৃষকরা। টানা বৃষ্টিতে এমন অপ্রত্যাশিত ক্ষতি হওয়ায় প্রান্তিক কৃষকরা চরম হতাশায় ভুগছেন।
মূলত, রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় চলতি মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় আমন ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এ মৌসুমে অধিক ফলনের আশা ছিল কৃষকদের, মাত্র কয়েকদিন পরেই আমন ঘরে উঠবে। কিন্তু এরইমধ্যে অসময়ের টানা বৃষ্টিতে ধানের ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। এতে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকেরা।
জানা গেছে, গত বুধবার থেকে রাজশাহী মহানগর ও আশপাশের উপজেলাগুলোতে থেমে থেমে বৃষ্টি শুরু হয়। প্রথম ২ দিন ভারী বৃষ্টি না হলেও পরের ২ দিন ধরে প্রচুর বৃষ্টি ও বাতাস বয়ে যাচ্ছে। রাতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যায়। এতে মাঠের পাকা আমন ধান পড়ে গিয়ে পানির নিচে তলিয়ে যায়। তানোর, পবা, মোহনপুর, বাগমারা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, গোদাগাড়ী উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে আমন ধান রোপণ করেছেন কৃষকরা। তবে বেশি ক্ষতি হয়েছে, পবা, তানোর ও বাগমারা ও মোহনপুর উপজেলায়। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা তারেক আজিজ বলেন, রাজশাহীতে ২৪ ঘণ্টায় ৬০ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পবা উপজেলার নিম্নাঞ্চলের মাঠে মাঠে সোনালি রঙে পাক ধরা রোপা আমন হঠাৎ দুই দিনের ঝড়ো হাওয়া ও ভারী বৃষ্টির কারণে মাজা ভেঙে জমিতে পানির নিচে পড়ে রয়েছে। তানোর উপজেলার চাঁন্দুড়িয়া, কামারগাঁ, পাঁচন্দর ও কলমা ইউনিয়ন এবং তানোর পৌরসভায় রোপা আমন ধান ডুবে গেছে। জমির পানি দ্রুত নিস্কাশন না হলে বেশি ক্ষতি হবে। এ নিয়ে কৃষকরা দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন। এছাড়া ভারী বৃষ্টির কারণে গ্রামীণ রাস্তা ঘাট পানিতে ডুবেছে। পুকুর ও খালের পানি ঢুকে পড়েছে গ্রামে। এতে অনেকে ঘরবন্দী হয়ে পড়েছেন।
তালন্দ ইউনিয়নের কালনা গ্রামের কৃষক হান্নান, তোফাজ্জল, বাদল ও হাসান আলী জানান, দুই দিনের ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টির পানিতে তাদের মাঠের ধান মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তানোর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, কামারগাঁ ব্লকের কামারগাঁয়ে ৩০ হেক্টর, মাদারিপুরে ৮ হেক্টর, ছাঐড়ে ১৪ হেক্টর, কৃষ্ণপুরে ৫ হেক্টর; পাঁচন্দর ব্লকের মোহাম্মদপুরে ৭ হেক্টর, চাঁদপুরে ১০ হেক্টর এবং চান্দুড়িয়া ব্লকের চান্দুড়িয়ায় ১৫ হেক্টর, সিলিমপুরে ৫ হেক্টরে রোপা আমন ধান পানিতে ডুবেছে।
এছাড়া তানোর পৌরসভায় ডুবেছে ১১০ হেক্টর। সব মিলে ২০৩ হেক্টর রোপা আমন ধান পানিতে ডুবেছে। তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহম্মেদ বলেন, উপজেলায় রোপা আমনের চাষাবাদ হয়েছে ২২ হাজার ৪৩৫ হেক্টর জমিতে। তবে ধান ডুবেছে পুরোপুরি ভাবে ৪৬ হেক্টর এবং আংশিক ডুবছে ১৫৭ হেক্টর জমি।
এই অঞ্চলের কৃষকরা বলছেন, গত দুই দিনের টানা বর্ষণে রোপা আমনের পাকা ধানের জমিতে হাটু পরিমান পানি জমে রয়েছে। জমি থেকে পানি নামছে খুব ধীর গতিতে। জমির পানি নেমে দ্রুত নেমে না গেলে ধান পচে যাওয়ার পাশাপাশি ধান নষ্ট হয়ে যাবে। অপরদিকে এলাকার ভেঙে যাওয়া মাটির বাড়ির মালিকরা বলছেন, হঠাৎ টানা বর্ষনে খাল নিয়ে পানি নামতে না পারায় পাড়া মহল্লা ও পাঁকা রাস্তার উপর দিয়ে পানির স্লোত গেছে এই স্রোতে মাটির বাড়ি গুলো ভেঙে পড়েছে। একই কথা বলছেন, মৎস্য চাষরা, তারা বলছেন হঠাৎ টানা বর্ষনে কিছু বুঝে উটার আগেই পুকুরে পানি ডুকে ভেষে গেছে পুকুর ও পুকুরের মাছ। এতে করে তানোর উপজেলার কৃষকসহ মৎস্য চাষী ও সাধারন মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পানিতে ডুবে যাওয়া রাস্তাগুলো ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
এদিকে বাগমারা ও তার পাশের এলাকায় ঘূর্ণিঝড় মোন্থা’র প্রভাবে অসময়ে প্রচুর বৃষ্টিতে মাঠ-ঘাটে ফসলের জমিতে পানি থৈ-থৈ করছে। গত বুধবার বিকেল থেকে শনিবার পর্যন্ত এলাকায় দফায় দফায় হালকা বৃষ্টি হলেও গত শনিবার রাতে অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিতে এলাকার কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। অতিবর্ষণে মাঠ-ঘাট পানিতে ডুবে রবি মৌসুমের উড়তি রোপা-আমন ধান, রোপণকৃত পিঁয়াজ, সরিষা, পানবরজ, মরিচ, বেগুন, শিমসহ নানা ফসল ও পুকুর ভেসে চাষিরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
বালানগর গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম, আনছার আলী ও ফসির উদ্দিন জানান, সরিষা বপনের উপযুক্ত সময় পেয়ে সরিষা ৫/৬ দিন আগে রোপণ করা হয়। কিন্ত বপনের পরের দিন থেকে বৃষ্টিতে জমিতে পানি আটকে আছে। বাগমারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চলতি মৌসুমে শাক-সবজি, মরিচসহ বেশ কিছু ফসলে চাষিরা লাভবান হওয়ার কথা থাকলেও প্রচুর বৃষ্টিতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া তানোর-গোদাগাড়ীর কোনো কোনো এলাকার হঠাৎ বন্যায় পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।
তানোর উপজেলা মৎস্য সহকারী কর্মকর্তা হাজিজুর রহমান জানান, হঠাৎ করে একদিনের টানা বর্ষণে তানোর উপজেলাজুড়ে প্রায় শতাধিক পুকুর ডুবে ভেসে গেছে। তবে মাছ চাষিদের কেমন ক্ষতি হয়েছে তা নির্দিষ্ট ভাবে জানাতে পারেনি মৎস্য অফিস কর্তৃপক্ষ। তানোর উপজেলা কৃষি অফিসার সাইফুল্লাহ আহমেদ বলেন, যদি সোমবারের মধ্যে জমি থেকে পানি নেমে যায় তাহলে রোপা আপন ধানের তেমন ক্ষতি হবে না। এরপরও যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে ক্ষতি হবে। তিনি বলেন এখনো ক্সতির পরিমান নির্ধারণ করা হয়নি, সোমবারের পর মাঠ ঘুরে ক্ষতির পরিমান নির্ধারণ করা হবে কত পার্সেন্ট ক্ষতি হবে। তবে, আলু রোপন পিছিয়ে যাবে বলেও জানান এই কৃষিবিদ।
এদিকে, গতকাল রোববার সকাল ও দুপুরে দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকেরা যে ধান ঘরে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেটিই এখন বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। নিচু জমির অধিকাংশ রোপা আমন খেত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ধান নষ্ট হচ্ছে। অনেক মাঠে ধান গাছ একেবারে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। যা কাটা ও শুকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শালঘরিয়া গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস বলেন, প্রায় ১ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা পুরোটাই পড়ে গেছে। বরজে পানভর্তি ছিল। পানের দাম বাড়ার আশায় পান ভাঙা হয়নি। হঠাৎ বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া সবকিছু এলোমেলো করে দিল। প্রায় তার পানবরজে আড়াই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে দাবি করেন কুদ্দুস।
শ্যামপুর গ্রামের আলামিন হক বলেন, দুই বিঘা জমিতে মুড়ি পেঁয়াজ লাগানোর পর থেকেই হালকা বৃষ্টি। তাতে সামাল দেওয়া গেলেও শুক্রবার দিবাগত রাতের বৃষ্টি সব কিছু শেষ করে দিলো। শুধু আমার না সব এলাকার পেঁয়াজ চাষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে শনিবার বিকেল ৪টায় দুর্গাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাহারার পারভীন লাবনী একাধিক বার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। পরে এক ঘন্টা পর আবারও কল করা হলেও তিনি কলটি কেটে দেন।
অন্যদিকে পাশ্ববর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. ইয়াছিন আলী জানান, শুক্রবারের বৃষ্টিতে কিছু শিষফোটা রোপা-আমন, সরিষা, মাসকালাই, মুড়ি পিয়াজ, শীতকালীন শাকসব্জির ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ২৩৫ হেক্টর রোপা আমন, ৩৭ হেক্টর আলু, ৯১৭ হেক্টর সরিষা, শাকসবজি ৩১৬ হেক্টর, ২৪৪ হেক্টর পেঁয়াজ, ২৫০ হেক্টর মাসকলাই, ৬৮ হেক্টর ভুট্টা, ১৩ হেক্টর স্ট্রবেরি, ৩৭৯ হেক্টর রসুন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরির সময় মোট ক্ষতি ও কৃষকের সংখ্যা জানা যবে বলে তিনি জানান।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহীনূর রহমান জানান, ভারী বৃষ্টিতে পুকুরের পানি উপচে পড়েছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, এতে ৮৩ লাখ টাকার ৪০ মে. টন মাছের ক্ষতি হয়েছে। পদ্মা নদীতে পানির ঢল নামার কারণে সদর উপজেলার দেবীনগর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের চরদেবীনগর গ্রামের কসিমুদ্দিন ১৮ কাঠা এবং কালু মিয়ার প্রায় ১৫ কাঠা এলাকা জুড়ে দহা বা বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, দ্রুত জমির পানি নিষ্কাশন করা গেলে বৃষ্টিতে ধানের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। কৃষকদের বিভিন্নভাবে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ বছর রাজশাহীতে ৮৩ হাজার ৫৫০ হেক্টের জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। চলতি মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় ভালো ফলন হবে আশা করা হচ্ছে।











