রাকসু নির্বাচন: অনাবাসিক ও নারীদের ভোট টানতে নানা পদক্ষেপ

ইরফান তামিম, রাবি থেকে: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের বাকী মাত্র এক সপ্তাহ। দুর্গাপূজার ছুটির পরে নির্বাচনি প্রচারণায় কিছুটা ভাটা পড়লেও চলছে নানান আলোচনা। প্রার্থী ও প্যানেলগুলো ইতিমধ্যে ভোটের মাঠের অনেক ছক কষতে শুরু করেছে।
ভোটের মাঠের হিসেবে প্রায় ৪ হাজার ভোট প্রথম বর্ষের। তাদের ভোট টানতে গ্রহণ করা হচ্ছে নানান কৌশল। এ ছাড়াও দুই তৃতীয়াংশ অনাবাসিক ও প্রায় ৪০ শতাংশ ছাত্রী ভোটারদের ভোট নিজেদের পক্ষে নিতে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে প্যানেলগুলোর প্রার্থীরা।
প্রার্থীরা বলছেন, নারী শিক্ষার্থীদের কানেক্ট করতে চলছে প্রজেকশন সভা। প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষেরসহ বিভিন্ন বর্ষের অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোটের জন্য ছুটে যাচ্ছেন তাদের ছাত্রাবাসের দুয়ারে।
প্রথম বর্ষের ভোটার
রাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয় গত ২৮ জুলাই। এদিকে ২০২৪-২৫ বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হয় ১৭ আগস্ট। এতে নির্বাচনের ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তির দাবি তোলে শাখা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। প্রথমে তাদের দাবি মেনে নেয় না নির্বাচন কমিশন। পরে গত ৩১ আগস্ট নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের চেয়ার ভাঙচুর করে তালা দিয়ে কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয় ছাত্রদল। ওইদিন ছাত্রদলের সঙ্গে ছাত্রশিবির ও শিক্ষার্থীদের ধাক্কাধাক্কি হয় কয়েক দফায়। পরে সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রথম বর্ষকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে কমিশন। তাদের ভোট নিজেদের পক্ষে নিতে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির উভয় প্যানেল নিজেদের প্যানেলে রেখেছেন ওই বর্ষের শিক্ষার্থীদের। তাদের নিয়ে চায়ের দোকানে, ছাত্রাবাসে করছেন ছোট ছোট সভা।
এ বিষয়ে ছাত্রদল মনোনিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী নাফিউল জীবন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন একটা বর্ষের ৪ হাজার শিক্ষার্থীকে বাদ রেখে নির্বাচন করতে চেয়েছিলো। ছাত্রদল তাদের ভোটাধিকারের জন্য লড়াই করেছে। আমি বিশ্বাস করি আমাদের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা মনে রাখবেন কারা তাদের জন্য লড়াই করেছিলো।’
অনাবাসিক শিক্ষার্থী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ আবাসিক হলে থাকেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা সাধারণত ক্যাম্পাসের আশেপাশের কাজলা, বিনোদপুর, মেহেরচন্ডী, ভদ্রা এলাকার বিভিন্ন ছাত্রাবাসে থাকেন। দিনের শুরুতে তারা ছাত্রাবাস থেকে এসে ক্লাসে অংশগ্রহণ করেন। এই শিক্ষার্থীদের বড় অংশই আবাসিক হলমুখী না। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের এমন অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তারা কীভাবে প্রার্থীদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন এবং ভোট দিতে প্রার্থীদের কোন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিবেন।
তাদের ভাষ্যমতে, তাদের ছাত্রাবাসগুলোতে কয়েকটি প্যানেলের প্রার্থীরা ভোট চেয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের একটি অংশ তাদের ছাত্রাবাসে গিয়ে ভোট ও দোয়া চেয়েছেন। তবে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট প্যানেলগুলো তাদের মেসে বেশিই যাচ্ছেন। এ ছাড়াও তাদের সঙ্গে প্রার্থীরা ক্লাসের শেষে বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক ভবন, টুকিটাকি চত্তর, পরিবহন মার্কেট, পরিবহনের বাসে প্রচারণা চালিয়েছেন। তবে হলে হলে প্রজেকশন সভাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সঙ্গে তারা নিজেদের সংযুক্ত করতে পারছেন না। সার্বিক বিষয়ে ভোটের বিষয়ে তারা এখন-ও চূড়ান্তভাবে কাকে ভোট দিবেন এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
তবে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ তার নিজ বিভাগ ও এলাকার প্রার্থীদের ভোট দিবেন বলে জানিয়েছেন। তারা বলছেন, রাকসু, হল সংসদ ও সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে তাদের প্রায় ৪০ এর অধিক পদে ভোট দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যে পদগুলোতে তাদের নিজ বিভাগ ও এলাকার প্রার্থী আছেন সেখানে তারা ওই প্রার্থীদের ভোট দিবেন। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফজলে রাব্বি। তার বিভাগ থেকে বিভিন্ন পদে প্রায় ২২ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। তিনি বলেন, ‘আমার বিভাগ থেকে কয়েকজন বড় ভাই ও আপু নির্বাচন করছে। আমি তাদেরকে তো ভোট দেব। এর বাইরে আমি দেখছি, বিবেচনা করছি নির্বাচনের আগে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’
নারী ভোটার
রাকসুর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী, এবার মোট ভোটার ২৮ হাজার ৯০১ জন, যার মধ্যে ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৩০৫ জন। শতাংশের হিসেবে ছাত্রী ভোটার ৩৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সংসদে মোট প্রার্থী ২৪৭ জন। এর ভেতর নারী প্রার্থী মাত্র ২৬ জন।
অনেকের মতে, রাকসু নির্বাচনের একটি বড় ‘ফ্যাক্টর’ নারী ভোটাররা। তাদের ভোটকে নিজেদের পক্ষে নিতে নানান কর্মসূচি চালাচ্ছে প্রার্থী এবং প্যানেলগুলো। প্রার্থী ও নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের হলগুলোতে ইতিমধ্যে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল প্রজেকশন সভা করেছে। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের পরিচিত নারী শিক্ষার্থীদের সহায়তায় নিজেদের প্রচারপত্র পাঠাচ্ছেন।
জুলাই-৩৬ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ত্বাসিন সিদ্দিকা রূপা বলেন, ‘আমাদের হলে আমি আমার পরিচিত কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচারপত্র বিতরণ করেছি। এ ছাড়া আমাদের হলে প্রজেকশন সভা হচ্ছে। সামনে আরও কয়েকটি প্যানেল এ সভা করবে বলে আমরা জেনেছি।’
যা বলছে প্যানেলের নেতারা
ছাত্রদল মনোনিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী নাফিউল জীবন বলেন, ‘আমাদের নারী শিক্ষার্থীদের কানেক্ট করতে আমরা প্রজেকশন সভা চালাচ্ছি। এ ছাড়াও আমরা প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয়সহ অন্যান্য বর্ষের অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের ছাত্রবাসে যাচ্ছি। তাদের সঙ্গে সেখানে আমরা প্রচারণা করছি, তাদের আকাক্সক্ষার কথা শুনছি।’
ছাত্রশিবির মনোনিত প্যানেল ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’র জিএস প্রার্থী ফাহিম রেজা বলেন, ‘নির্বাচনী মাঠে অনাবাসিক শিক্ষার্থী, ছাত্রী ভোটারদের জন্য ভিন্ন কিছু কাজ করছি। অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত করতে আমরা তাদের ছাত্রবাসে যাচ্ছি। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা তাদের হলগুলোতে প্রজেকশন মিটিং করেছি। আশা করছি তারা আমাদের তারা আরও ভালোভাবে জানার সুযোগ পেয়েছে।’
আধিপত্যবাদবিরোধী ঐক্য প্যানেলের জিএস প্রার্থী সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘শিক্ষার্থীরাই আমার নির্বাচনের মূল ফ্যাক্টর। ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবিরের মতো সংগঠনগুলো বিনিয়োগ করেছে। এতে তাদের রিজার্ভ ভোটও তৈরি হয়েছে। আমি মনে করি, রাজনৈতিক দল, বিভাগ ও জেলা সমিতি না দেখে প্রতিটি ব্যক্তির কার্যকলাপের ওপর নজর দেয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভোট দেওয়ার সময় অবশ্যই লক্ষ্য করা উচিত যে মানুষটি কেমন। তার যোগ্যতা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য তার কাজের মূল্যায়ন করা উচিত।’
রাকসু ফর রেডিক্যাল চেঞ্জ’র ভিপি প্রার্থী মেহেদী মারুফ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বড় বড় সংগঠন রয়েছে, যারা রিজার্ভ ভোটের অধিকারী। এ ছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থী অনাবাসিক এবং তাদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। তাদের কানেক্ট করতে আমাদের ছাত্রাবাসে যাওয়া, ক্লাসের পরে একাডেমিক ভবনের সামনে প্রচারে গুরুত্ব দিয়েছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত রাজনৈতিক সচেতন। তারাই আমার নির্বাচনের মূল ফ্যাক্টর। আমি তাদের বলব প্রার্থীদের মধ্যে যাঁরা অতীতে লড়াই সংগ্রাম করেছেন এবং শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করেছেন, তাঁদের কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের ভোট দেওয়া উচিত।’
সাবেক সমন্বয়ক ও সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদের ভিপি প্রার্থী তাসিন খান বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে আমার কাজ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে নিয়ে। আমি চাই যে, প্রার্থীর ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা ও উপলব্ধি দেখেই শিক্ষার্থীরা আমাকে নির্বাচিত করুক। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীই আমার ভোটের ফ্যাক্টর। আমরা এই চিন্তা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।’