ঢাকা | অক্টোবর ৮, ২০২৫ - ১:০৬ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম

বরেন্দ্র অঞ্চলে খেজুর রস সংগ্রহে গাছিদের প্রস্তুতি

  • আপডেট: Tuesday, October 7, 2025 - 9:00 pm

শিশির বিন্দুতে আগাম শীতের বার্তা:

স্টাফ রিপোর্টার: ‘বরেন্দ্র অঞ্চল’ খ্যাত উত্তর জনপদের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় আগাম শীতের আমেজ দেখা দিচ্ছে। সড়কের আশেপাশে, পুকুর পাড়ে, গাছের ডালে ও ফসলের জমিতে ধানের পাতায় জমে থাকা বিন্দু-বিন্দু শিশিরই যেন বলে দিচ্ছে শীতকাল আসন্ন।

ছয় ঋৃতুর সুজলা-সুফলা সবুজে ঘেরা শ্যামল বাংলাদেশে ভোরের আকাশে সূর্যের উষ্ণ তাপে রাত নামলেই হিমেল হাওয়ায় জানান দিচ্ছে শীতের আগাম উপস্থিতি। শীতকে মাথায় রেখে রাণীনগরের গ্রামীণ জনপদে খেজুর গাছে চড়ে গাছিরা রস সংগ্রহের প্রস্তুতির জন্য ইতিমধ্যেই গাছ পরিস্কার করা শুরু করেছেন। আর সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই গাছ থেকে রস সংগ্রহের পর্ব শুরু হবে বলে আশা স্থানীয় গাছিদের।

খেজুর রসের জন্য রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর উপজেলা বেশ বিখ্যাত। রাজশাহীর দুর্গাপুরে সুমিষ্ট খেজুর রস সংগ্রহের লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই খেজুরগাছ পরিচর্যা শুরু করেছেন গাছিরা। আগামী ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যেই রস সংগ্রহ আরম্ভ হবে। মৌসুম শুরু হতে না হতেই গাছিরা দড়ি, হাঁসুয়া, ঠুঙ্গিসহ গাছ কাটার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে গাছ কাটার জন্য ব্যস্ত সময় পার করছেন। রস সংগ্রহের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে খেজুরগাছের চূড়া ঝুড়ে দিচ্ছেন। গাছি বড়, বড়, হাঁসুয়া দিয়ে খেজুরগাছের মাথার ডাল কেটে চেঁছে সাদা অংশ বের করছেন। যাকে দুর্গাপুরের ভাষায় বলা হয় গাছ ঝোড়া।

রস সংগ্রহ শুরু হলে গ্রামবাংলার প্রতিটি পরিবারে সকাল শুরু হবে, সুমিষ্ট খেজুর রস সঙ্গে মুড়ি দিয়ে। ঘরে ঘরে তৈরি হবে পাটালি গুড়, ঝোলা গুড়, নানা পদের পিঠাপুলি। গুড় বিক্রি করে সচল হবে, গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তথ্য মতে, উপজেলা জুড়ে খেজুরগাছ রয়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ছয়শ’ পঁচিশ টি। বার্ষিক গুড় উৎপাদন হয় চারশ’ পঞ্চান্ন টন। গড়ে বছরে প্রতিটি গাছ থেকে ৯ কেজি করে গুড় উৎপাদন হয়।

এদিকে, খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের প্রস্তুতির চিত্র নওগাঁ জেলার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামে-গ্রামে চোখে পড়তে শুরু করেছে। রস ও গুড়ের জন্য রাণীনগর উপজেলার এক সময় খ্যাতি থাকলেও সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে। এক সময় অধিকাংশ বাড়িতে, খেতের আইলে, ঝোপ-ঝাড়ে পুকুর পাড়ে ও রাস্তার দুই ধার দিয়ে ছিল অসংখ্য খেজুর গাছ। কোনো পরিচর্যা ছাড়াই অনেকটা প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠতো এসব খেঁজুর গাছ। পরিবারের চাহিদা পুরণ করে অতিরিক্ত রস দিয়ে তৈরি করা হতো সুস্বাদু খেজুরের গুড়। ইট ভাটার রাহুগ্রাসে ও অন্যান্য জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছের ব্যবহার বেশি হওয়ার কারণে যে পরিমাণ গাছ চোখে পড়ে; তা নির্বিচারে নিধন করায় দিন-দিন খেজুর গাছ কমে যাচ্ছে।

উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের কুজাইল গ্রামের আজাদ প্রামানিক জানান, আমার ৫টি খেজুর গাছ আছে। গত বছরের মতো এবারও গাছিদেরকে প্রতিটি গাছ ৩ কেজি গুড় দিবে বলে বর্গা দিয়েছি। রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলা থেকে আসা গাছিয়া মামুন প্রামানিক জানান, আমরা প্রতি বছর এই এলাকায় আসি। এ বছর গোনা ইউনিয়নের ভবাণীপুর সরদারপাড়া গ্রামের জামিলের পুকুরপাড়ে আমরা আছি।

শীত মৌসুমে খেজুর গাছ মালিকদের কাছ থেকে প্রায় ৪ মাসের জন্য গাছ ভেদে ২ থেকে ৩ কেজি করে খেজুরের গুড় দিয়ে গাছগুলো আমরা বর্গা নিয়ে থাকি। চাহিদা মতো খেজুর গাছ না পাওয়ার কারণে রস কম হওয়ায় আশানুরুপ গুড় তৈরি করতে পারি না। যার কারণে তেমন পোষায় না। তারপরও এ বছর প্রায় শতাধিক খেঁজুর গাছের মালিকদের সাথে চুক্তি করেছি। দাম বেশি হলে এ বছর লাভ ভালো হবে এমনটাই আশা করছি।

অন্যদিকে, রাজশাহীর দুর্গাপুরে প্রতি সিজনে ৭০ কোটি টাকার গুড় কেনাবেচা হয়। রোববার সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, কয়েক হাজার গাছি রস সংগ্রহের লক্ষ্যে গাছের পরিচর্যা শুরু করে দিয়েছেন। গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য মাটির তৈরি পাত্র ( কোর) সংগ্রহ করে দড়ি লাগাচ্ছেন, পুরানো পাত্রগুলো, ধুয়ে শুকিয়ে রাখছেন। রস জ্বাল দেওয়ার জন্য বড় টিনের পাত্র সংগ্রহ করছেন এবং কাদামাটি দিয়ে চুলা মেরামত করছেন।

উপজেলার হোজা এলাকার গাছি মনোয়ার হোসেন জানান, গত বছর আমি ৪০টি খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করেছি। এবার ৫০টি খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করব। প্রতিটি খেজুরগাছ এক সিজনের জন্য ৬০০ টাকা করে টেন্ডার নিয়ে নিয়েছি। গাছ পরিচর্যা করছি, আশা রাখি পর্যাপ্ত শীত পড়লে ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যেই রস সংগ্রহ করতে পারব। নিজে পরিশ্রমের মাধ্যমে গুড় উৎপাদন করে প্রতিবছর ভালোই লাভ হয়। আশা রাখি এবার গুড়ের দাম ভালো থাকলে কৃষকরা লাভবান হবে।

উপজেলার রৈপাড়া এলাকার গাছি মনিরুল ইসলাম জানান, আমার প্রায় ৭০টি খেজুর গাছ রয়েছে। গাছগুলো পরিষ্কার করে রাখছি শুকানোর জন্য। শীত পড়া শুরু হলে যাতে আগাম রস সংগ্রহ করতে পারি।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার তোহিদুর রহমান জানান, খেজুরগাছ দক্ষ গাছি দিয়ে পরিষ্কার করানো উচিত। পরিচর্যার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে গভীর করে উভয় পাশের গাছ ঝোড়া না হয়। এতে করে গাছ মারা যেতে পারে, এক পাশে গাছ ঝুড়তে হবে। ভালো রস উৎপাদন পেতে প্রতিটি গাছের গোড়ায় ১০০ থেকে দেড়শ’ গ্রাম ইউরিয়া সার বৃত্তাকারভাবে মাটি খুঁড়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে। আশা রাখি আগামী অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে রস সংগ্রহ শুরু হবে। দাম ভালো থাকলে কৃষক লাভবান হবে।