ঢাকা | সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫ - ৪:৫৩ পূর্বাহ্ন

সীতাকুণ্ডে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন চারঘাটের যুবক

  • আপডেট: Friday, September 26, 2025 - 11:16 pm

স্টাফ রিপোর্টার: ঋণের ফাঁদ থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছিলেন না মিঠুন দাস (২৮)। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির চাকরি আর সিসি ক্যামেরা লাগানোর ব্যাবসা থেকে যে আয়-রোজগার হচ্ছিল, তার প্রায় সবই চলে যাচ্ছিল শুধু সুদ দিতে। ক্লান্ত-শ্রান্ত মিঠুন বাসে যাচ্ছিলেন। বন্ধ হয়ে এসেছিল চোখ।

তখনই ব্যাগ থেকে চুরি হয়ে যায় কোম্পানির প্রায় ৩ লাখ টাকা। আর চাপ সহ্য করতে পারেননি মিঠুন। ফেসবুকে লাইভে এসে দুঃখের কথাগুলো বলে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এখন প্রায় ৫ লাখ টাকার ঋণের বোঝা এসে পড়েছে পরিবারের ওপর। অথচ সংসারে এখন উপার্জন করার কেউ নেই। এই ঋণ শোধ করবেন কীভাবে, তা চিন্তা করে কূল-কিনারা পাচ্ছেন না মিঠুনের মা শ্রীমতী রানী।

মিঠুনের বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বনকিশোর গ্রামে। বাবার নাম প্রেমানন্দ দাস। ১৪ মাস আগে নাটোরের মেয়ে বিউটি দাসের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মিঠুনের। অনেক দিন থেকেই মিঠুন থাকতেন কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর এলাকায়। সেখানে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে দেয়ার ব্যাবসা করতেন। তিন মাস আগে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে ১০ হাজার টাকা বেতনের একটি চাকরিও নিয়েছিলেন। গত মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডুতে একটি ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। এর আগে বিকেলে ফেসবুকে লাইভে এসে মিঠুন বলেন, কোনো দিন ভাবিই নাই এ সিদ্ধান্ত নিব।

এর আগে সিদ্ধান্তটা নিলে ক্ষতিটা হইত না। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ডিসেম্বর মাস থেকে বিপদ পিছু ছাড়ছে না। মা লক্ষ্মীও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কোম্পানির ৩ লাখ টাকার মতো হারাই ফেলছি। কেউ বিশ্বাসও করবে না। জানি আমার পরিবারটাকে দেখার কেউ নাই। কিন্তু এই মুখ নিয়ে মা-বাবাকে কীভাবে জানাব? একটু থেমে মিঠুন বলেন, আমি চলে যাইতেছি। যাঁরা আমার কাছ থেকে টাকা পান, ক্ষমা করে দিয়েন আমাকে। আমি আমার নিজের চোখে পরিবারটাকে শেষ হতে দেখতে পারি না। সরকারের কাছে একটাই আবেদন, পরিবারটাকে ঋণমুক্ত কইরেন, পরিবারটাকে বাঁচায়ে রাইখেন, শেষ হতে দিয়েন না। না ভালো স্বামী হইতে পারলাম, না ভালো সন্তান, না ভালো ভাই। মা-বাবা ক্ষমা করে দিও। বিউটিকে একটা ভালো ছেলে দেইখে বিয়ে করায় দিও। যাঁরা টাকা পান, আমার পরিবারটাকে চাপ দিয়েন না। ওরা দিতে পারবে না।

রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে বনকিশোর গ্রাম। গত বৃহস্পতিবার মিঠুনদের বাড়ি যেতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। বাড়ির সামনেই বসে ছিলেন মিঠুনের মা শ্রীমতি রানী। তাঁকে ঘিরে ছিলেন পাড়ার নারীরা। শ্রীমতি জানালেন, মঙ্গলবার দুপুরে মিঠুন তাঁকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘মা, ভালো আছো?’ তাকে বলেছিলাম, ‘ভালো আছি, তুমি কোথায়?’ কিন্তু কোনো জবাব আসেনি। ফোনটি কেটে যায়। শ্রীমতি ফোন করলেও নম্বরটি বন্ধ পান। রাতে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে ছেলের আত্মহত্যার খবর পান তাঁরা। বুধবার রাত ১টায় লাশ আসে। ওই রাতেই বাড়ির পাশে বড়াল নদের তীরে মিঠুনের মরদেহ সমাহিত করা হয়।

মিঠুনের মা জানান, আগে শুধু সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজই করতেন মিঠুন। আগাম টাকা নিয়ে বাসায় কিংবা অফিসে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে দিতেন। গত ডিসেম্বরে এভাবে নেওয়া দেড় লাখ টাকা এক বন্ধুকে দিয়েছিলেন সিসি ক্যামেরা কিনতে। ওই বন্ধু টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। তখন মিঠুন বাধ্য হন ধারদেনা করে দেড় লাখ টাকার সিসি ক্যামেরা কিনে দিতে। এই ক্যামেরা লাগানোর সময় ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারেননি মিঠুন। ভুল করে বেশি ভোল্টে সংযোগ দিলে সব সিসি ক্যামেরা পুড়ে যায়। আবার ২ লাখ টাকা জরিমানা দিতে করা হয় ঋণ। এই এক কাজ করতে গিয়েই সাড়ে ৩ লাখ টাকা ঋণ হয়ে যায়।

মিঠুন দাউদকান্দিতে তিনটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ করেন। শ্রীমতি রানীও ননদের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা ধার করে দেন। এ ছাড়া একটি সংস্থা থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দেন। ব্যবসার জন্য দাউদকান্দিতে সুদের ওপর ৫০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন মিঠুন। চারঘাটে স্বর্ণকারের দোকানে গয়না বন্ধক রেখে শ্রীমতি রানীও ছেলেকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এই ১ লাখ টাকার জন্য প্রতি মাসে হাজারে ১০০ টাকা হিসাবে মাসে ১০ হাজার টাকা সুদ দিতে হতো। কুলিয়ে উঠতে না পেরে ১০ হাজার টাকা বেতনে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন মিঠুন।

কোম্পানির কালেকশন করা প্রায় ৩ লাখ টাকা বাসে চুরি হয়ে গেলে মানসিকভাবে মিঠুন ভেঙে পড়েন। মিঠুনের মা বলেন, ‘আমার আর কোনো ছেইলে নাই। ওর বাপে আগে ভ্যান চালাত। এখুন অসুস্থ হইয়ে পইড়ে আছে। মাথার ওপর এতগুলো ঋণ। আমার বাকি দিনডা চালিয়ে নিবে কে?’ মিঠুনের স্ত্রী বিউটি দাস নির্বাক বসে ছিলেন। তিনি শুধু বললেন, ‘মঙ্গলবার শেষবার আমাকে ফোন করে বলেছিল সে আছে চট্টগ্রামে। বলেছিল, কাজে আছে। পরে কথা বলবে। আর কথা হলো না।’