চারঘাটে ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে

মোজাম্মেল হক, চারঘাট থেকে: তাঁতের খট খট শব্দে এক সময় মুখরিত থাকত তাঁতপল্লিগুলো। তাঁত শিল্প এক সময় বেশ সমৃদ্ধ ছিল কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কারণে এই শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। দফায় দফায় তাঁত কাপড়ের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ তুলতে পারছে না প্রান্তিক তাঁতিরা।
একের পর এক তাঁত বন্ধ হয়ে বিলুপ্তির পথে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প। আধুনিকতার সাথে তাল মেলাতে না পারার কারণে এই শিল্পের সাথে জড়িতরা সমস্যায় পড়ছেন। এমনকি এ পেশা বদল করে আজ অন্য পেশায় চলে গেছে।
অনেকে আবার বাপ-দাদার এই পেশাকে প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও স্মৃতি হিসেবে আঁকড়ে ধরে আছে। এক সময় বিরামহীনভাবে কাজ করে যেতেন তাঁতিরা। কিন্তু তাঁত শিল্পের এখন আর সেই সুদিন নেই।
সরেজমিনে শনিবার সকালে চারঘাট উপজেলার মুংলী, অনুপমপুর, ইউসুফপুর, শলুয়া ইউনিয়নের তাতারপুর, সরদহ ইউনিয়নের হুজারপাড়া গ্রামগুলো ঘুরে জানা যায়, এক সময় তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে বেশ পরিচিত ছিল। এখানকার তাঁতিদের উৎপাদিত বিভিন্ন বাহারি ডিজাইনের গামছা, চাদর, শাড়ি ও বিছানার চাদর দেশের বিভিন্ন বাজারে নিয়ে বিক্রি করা হতো।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এসব এলাকা থেকে তাঁত শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। তাঁত বস্ত্র উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও রাসায়নিক দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই উপজেলার তাঁত শিল্পের অস্তিত্ব বর্তমানে হুমকির মুখে পড়েছে। লাভজনক এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
জানা যায়, বর্তমানে চারঘাট উপজেলায় প্রায় ৫০০ তাঁত শিল্প পরিবার আছে। তাঁতের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিবারগুলো বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ তাঁত শিল্প পরিবার। অবিরাম লোকসানে পড়ে পেশা বদলেছেন অনেকেই।
তাঁতিদের অভিযোগ সুতা, রং, কেমিক্যালসহ তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের সব উপকরণের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যয় যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে সে অনুযায়ী উৎপাদিত কাপড়ের মূল্য বৃদ্ধি পায়নি। উপজেলার মুংলী গ্রামের তাঁতী নাজিমুদ্দিন বলেন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাপড় তৈরির সুতা, শ্রমিকের পারিশ্রমিক এবং যানবাহনসহ অন্যান্য দ্রব্যাদির ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত গতিতে। তবে বাড়েনি কাপড়ের দাম ও চাহিদা। যে কারণে দিনের পর দিন বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছে তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা।
উপজেলার ইউসুফপুর তাঁতীপাড়া গ্রামের গোলাম মোস্তাফা বলেন, আমি ছোট বেলা থেকেই তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত আছি। এক সময় আমাদের নিজস্ব তাঁতে তৈরি করা গামছা, লুঙ্গি, শাড়ি দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হত কিন্তু এখন আর তাঁত শিল্পের সেই পুরাতন ঐতিহ্য নেই। কারণ তাঁত সংশ্লিষ্ট পণ্য বৃদ্ধির কারণে এই গুলো আর এখন আগের মত চাহিদা নেই।
তবে আমি এখন আমার বাপ-দাদার এই পেশা ধরে রেখেছি বলে তিনি জানান। তাঁতী পাড়ার রুনা বেগম বলেন, আমার নিজ বাড়িতে তাঁতের কাজ করতাম।
তবে, বর্তমানে তাঁত উপকরণের দাম বেশি হওয়ায় তাঁত শিল্পের কাজ বন্ধ করে দিয়েছি বলে তিনি জানান। উপজেলার অনুপমপুর গ্রামের জামাল উদ্দিন এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতি পাউন্ড ৮০ কাউন্ট সুতা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা।
অথচ কয়েক মাস আগে এই সুতার দাম ছিল মাত্র ১৭০ থেকে ১৯০ টাকা। সুতার দামের পাশাপাশি রংয়ের দাম বেড়েছে প্রায় দিগুণ। দুই টাকার ইন্ডিয়ান রং এখন ৫ হাজারে কিনতে হচ্ছে। ৬০০ টাকার মাকু এখন দুই হাজার টাকা এবং ৭০০ টাকার সানা দেড় হাজার টাকা বলে তিনি জানান। বর্তমানে চারঘাট উপজেলা তাঁত শিল্পের খুব করুণ অবস্থা।
তারপরেও অনেকে নিজের বাপ-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এখনও কষ্ট করে ধরে রেখেছে। সব মিলে এখন চারঘাটের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।