ঋণের দায়ে ভারাক্রান্ত ভবিষ্যৎ

সম্পাদকীয়
সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি ও বাজেট ঘাটতি কমানোর চেষ্টার পরও রাষ্ট্রীয় ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। একটি সুস্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি পরিচালনার অন্যতম শর্ত হলো রাজস্ব আয়ে দৃঢ়তা এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ।
কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দুই ক্ষেত্রেই সরকারের সক্ষমতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ ২১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, যা আগামী তিন অর্থবছরে বেড়ে প্রায় ২৯ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাবে।
অর্থাৎ মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ঋণের পরিমাণ বাড়বে ৮ লাখ কোটি টাকারও বেশি। এটি শুধু পরিসংখ্যানগত কোনো সংখ্যা নয়-এই ঋণের চাপ সরাসরি দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন খাতের সক্ষমতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ওপর প্রভাব ফেলবে।
ঋণের এই ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতি যে একমাত্র অভ্যন্তরীণ কারণে হচ্ছে, তা নয়। বৈশ্বিক অর্থনীতির অনিশ্চয়তা, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থার ফলে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, এবং দেশিয় পর্যায়ে বিনিয়োগ স্থবিরতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনের শাসনের দুর্বলতা ইত্যাদি-সব মিলিয়ে এক জটিল ও বহুমাত্রিক চাপ তৈরি হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে কাক্সিক্ষত রাজস্ব আয় অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়েছে, যা আবার ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে বৈদেশিক সহায়তা এবং অনুদানের জায়গায় তুলনামূলক বেশি সুদের ঋণ নিতে হবে।
ফলে ঋণ পরিশোধের খরচও বাড়বে। একদিকে রাজস্ব আয় কম, অন্যদিকে ঋণ পরিশোধের খরচ বৃদ্ধি-এই দুইয়ের সম্মিলিত প্রভাব একটি বিপজ্জনক অর্থনৈতিক বৃত্ত তৈরি করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র কর আদায়ের প্রশাসনিক সংস্কার যথেষ্ট নয়।
রাজস্ব বৃদ্ধির পূর্বশর্ত হলো একটি স্থিতিশীল, আস্থাশীল এবং উৎপাদনমুখী ব্যবসা পরিবেশ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা, আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন, শিল্পপতি ও উদ্যোক্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অযথা হয়রানি বন্ধ করাই হতে হবে অগ্রাধিকার।
বর্তমান সরকার যদি সত্যিই ঋণের লাগাম টানতে চায়, তবে প্রয়োজন হবে একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক রূপরেখা। সেখানে রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কার, ব্যবসা পরিবেশ উন্নয়ন, আমদানি-নির্ভরতা হ্রাস, রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং জনখাতে অপচয় রোধের বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি থাকতে হবে।
এটি শুধুই অর্থনৈতিক ইস্যু নয়-এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রাপ্যতা, দেশের আর্থিক স্বাধীনতা ও উন্নয়ন ধারাবাহিকতার প্রশ্ন। তাই এখনই সময় দায়িত্বশীল ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেয়ার। নয়তো আমরা এমন এক ঋণচক্রে প্রবেশ করব, যার দায় বহন করবে আমাদের ভবিষ্যৎ।