ঢাকা | জুলাই ৭, ২০২৫ - ১২:১৪ অপরাহ্ন

শিরোনাম

রাজশাহীতে ফসলি জমি ও ধানের উৎপাদন দুটোই কমছে

  • আপডেট: Sunday, July 6, 2025 - 12:31 am

নির্বিচারে ইটভাটা, পুকুর খনন:

স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় ফসলি জমিতে পুকুর খনন, ইটভাটা, কলকারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলায় প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে ফসলি জমি। একইসঙ্গে কমছে ধানের উৎপাদনও।

ফলে, প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে জমির লীজের মূল্য ও ধানের দাম। কৃষকরা বলছেন, ফসলি জমি কমে যাওয়ায় কমেছে খাদ্য উৎপাদন এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে ধানের দাম। এ অবস্থা চলতে থাকলে রাজশাহী অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, একের পর এক অবৈধ ইটভাঁটি আর মাটি কেটে পুকুর খননের মহোৎসবে হুমকির মুখে পড়েছে রাজশাহী অঞ্চলের ফসলি জমি। সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ফসলি জমিতে পুকুর খনন আর পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়ায় গড়ে উঠছে ইটভাঁটি। ফলে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে ফসলি জমি।

পুকুর খননে হারিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি আর ইটভাঁটিতে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ, বিপর্যয় ঘটছে ফসলের। রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় অনুমতিবিহীন শতাধিক ইটভাঁটিতে এখন মারাত্মকভাবে দূষিত করছে পরিবেশ।

ফসলি জমিতে ইটভাঁটি হওয়ায় ক্রমেই কমছে আবাদি জমি। জনবসতি, ফসলি জমি ও গাছপালা রয়েছে এমন এলাকায় ইটভাঁটি গড়ে তোলা নিষিদ্ধ হলেও অবাধে নতুন নতুন ইটভাঁটি গড়ে উঠছে। কৃষি ও পরিবেশবিদরা বলেছেন, লোকালয়ের পাশে ফসলের জমিতে ইটভাঁটি গড়ে ওঠায় পরিবেশ দূষণসহ ফসলের ফলন কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকহারে। একইসঙ্গে ফসলি জমির ওপরের স্তর (টপ সয়েল) ইটভাঁটির পেটে চলে যাওয়ায় জমি হারাচ্ছে উর্বরা শক্তি।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও তথ্য সার্ভিস বিভাগের হিসাব মতে, ষাটের দশকে রাজশাহীতে কৃষিজমি ছিল ৪ লাখ ৫৫ হাজার ২৩৫ হেক্টর। তবে সেচ ও প্রযুক্তি না থাকায় তিন ভাগের একভাগ তথা মাত্র ১ লাখ ৫১ হাজার ৭৪৫ হেক্টর জমিতে কৃষিকাজ হতো। বাকি ৩ লাখ ৩ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমি অনাবাদি ও চারণভূমি হিসাবে ব্যবহৃত হতো।

আশির দশক থেকে ক্রমাগতভাবে সেচ সুবিধা বাড়তে থাকায় আবাদের আওতায় আসে অনেক জমি। তবে বর্তমানে দ্রুতহারে কমছে আবাদযোগ্য কৃষি।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হালনাগাদ হিসাবে জানা যায়, এ জেলায় বর্তমানে অবশিষ্ট রয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৯৩১ হেক্টর জমি। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে রাজশাহীতে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৮০ হেক্টর। ২০২৪ সালে আবাদযোগ্য জমি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৭৫৮ হেক্টর।

অর্থাৎ ১৭ বছরে রাজশাহী জেলায় আবাদযোগ্য জমি কমেছে ৩৬ হাজার ২২ হেক্টর। এসব জমির বড় অংশই চলে গেছে বাণিজ্যিক পুকুর খননে। পরের বছরগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ হতে যাচ্ছে বলে সচেতন মহলের আশঙ্কা। তারা জানিয়েছেন, রাজশাহীজুড়ে যেভাবে নির্বিচার ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর খনন ও আবাসিক প্লট হচ্ছে, তাতে ২০২৪ সাল শেষে আরও ২০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি নাই হয়ে যাবে।

জানা গেছে, তানোর উপজেলার চান্দুড়িয়া ইউপির সিলিমপুর ও হাড়দহ বিল নামে পরিচিত পুরো বিল জুড়ে এক সময় ধান চাষ করা হত। যা এখন শুধুই অতীত স্মৃতি। গত কয়েক বছরে সেই ফসলের বুক চিরে খনন করা হয়েছে শত-শত অবৈধ পুকুর। এসব পুকুর বন্ধে স্থানীয় কৃষকরা একাধিকবার প্রশাসনসহ উচ্চ পর্যায়ে লিখিত ও মৌখিকভাবে অভিযোগ করেও কোন সুফল পায়নি।

ওই এলাকার কৃষকরা বলছেন, বিলের ওই জমিতে বছরে একটা ফসল হওয়ায় তেমন লাভ হতো না। ভূমিদস্যুরা কৃষকদের লোভ দেখিয়ে ওইসব ফসলি জমি লীজ নিয়ে পুকুর খনন করেছেন। এলাকার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর আগেও প্রতি বছরের জন্য ১ বিঘা জমি লীজের মূল্য ছিলো ১০ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা।

বর্তমানে প্রতি বিঘা জমি ১ বছরের জন্য লীজের মুল্য বেড়ে দাড়িয়েছে ৪০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তাও আবার অহরহ পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষকরা বলছেন, নিচু জমিগুলোতে পুকুর খনন, উচু ও রাস্তার ধারের ফসলী জমিতে অপরিকল্পিতভাবে কলকারখানা ও ঘর বাড়ি নির্মানের কারনে ফসলি জমি কমে যাওয়ায় ফসলি জমির গুরুত্ব ও লিজের মূল্যে বেড়ে যাচ্ছে।

পাওয়া তথ্য মতে তানোরে উপজেলায় মোট কৃষি জমির পরিমাণ ২২ হাজার ৬শ ৬৫ হেক্টর এবং চাষযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ ২১ হাজার ২শ ৯৫ হেক্টর। বর্তমানে আলু ও রোপা আমন ধান চাষ হচ্ছে ১৩ হাজার ৩শ ৭৫ হেক্টর জমিতে। কমে যাওয়া ফসলি জমিগুলোতে খনন করা হয়েছে পুকুর। এছাড়াও আমসহ পেয়ারা বাগান, কলকারখানা, ও ঘরবাড়ি নির্মাণও করা হয়েছে।

তানোর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সব চাইতে বেশি পুকুর খনন করা হয়েছে চান্দুড়িয়া ইউপি এলাকায় এবং আমসহ পেযারা বাগান করা হয়েছে বেশি বাধাইড় ইউপি এলাকায়। তানোর ও মুন্ডমালা পৌর এলাকাসহ কলমা ইউপি, বাধাইড় ইউপি, পাচন্দর ইউপি, সরনজাই ইউপি, তালন্দ ইউপি, কামারগাঁ ইউপিসহ চান্দুড়িয়া ইউপির বিভিন্ন এলাকার ফসলি জমিতে তৈরি পুকুর খননের পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে পোলট্রি ফিড তৈরির কারখানা, কোল্ড স্টোর, ইট ভাটা, আম ও পেয়ারা বাগানসহ ঘর বাড়ি তৈরি করায় কমেছে ফসলি জমি। ফসলি জমি কমে যাওয়ার কারণে জমি লিজের মূল্য বৃদ্ধি পেছেছে। ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রতি বছরই প্রতি মনে ধানের দাম বাড়ছে ২শ টাকা থেকে ৩শ টাকা পর্যন্ত।

এর আগে সম্প্রতি বাগমারা উপজেলার নিমাই বিলের কৃষি জমিতে জোর জবরদস্তি অবৈধভাবে পুকুর খনন বন্ধের দাবিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে রাষ্ট্র সংস্কার কৃষক আন্দোলন, বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম ও সবুজ সংহতি, রাজশাহী মহানগর কমিটি। সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়, রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি বাগমারা উপজেলার নিমাই বিলের কৃষিজমিতে জোর জবরদস্তি অবৈধ পুকুর খননের মহোৎসব চলছে। কৃষি জমি রক্ষায় এ বিষয়টি প্রশাসনের দৃষ্টিতে আনার জন্য মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে।

এর পরেও কোন প্রতিকার না পেয়ে একটি মামলা করা হয়। বাগমারা উপজেলার এসি-ল্যান্ড বরাবর মামলাটির তদন্তভার রয়েছে। একই বিষয়ে কোন অগ্রগতি না ঘটলে হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট-পিটিশন দেয়া হয় এবং এই রিটে বাগমারা উপজেলায় পুকুর খননে স্থগিতাদেশসহ রাজশাহী জেলা প্রশাসক, ইউএনও, এসি-ল্যান্ডকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

নেতৃবৃন্দ জানান, আসামীরা দেশের প্রচলিত আইন, উচ্চ আদালতের রিট পিটিশনসহ সকল কিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে সন্ত্রাসী কায়দায় নিমাই বিলের প্রায় ষাট বিঘা কৃষি জমিতে ঈদ-উল-আজহার ছুটিতে আবারো জোরেশোরে খনন শুরু করেছে। তথাকথিত কতিপয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও ভূমি দস্যূরা এই কাজের সাথে জড়িত।

তারা প্রতিনিয়ত রাত ১১টার পর থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ৭টি স্কেভেটার মেশিন দিয়ে খনন কাজ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও দেশের প্রচলিত আইনে ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ, বাগমারা থানা, উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসনকে একাধিক বার অবগত করা হলেও তারা কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। বরং নীরব দর্শক এর ভূমিকা পালন করেছে। অবৈধ খননের কারনে কৃষকদের আবাদ নষ্ট হয়েছে এবং জমি আবাদের অনুপযোগী হওয়ায় কৃষকরা অনিশ্চিত ভবিষৎ এর মধ্যে পড়েছেন।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক উম্মে ছালমা গণমাধ্যমকে বলেন, কৃষিজমির শ্রেণি বদল করা বেআইনি। তারপরও শত শত একর কৃষিজমি ধ্বংস হচ্ছে। কাটা হচ্ছে পুকুর। জমি ভরাট করে প্লট হচ্ছে। অভিযোগ পেয়েও কিছু করতে পারছি না। ব্যবস্থা নিতে পারে উপজেলা ভূমি প্রশাসন।

নির্বিচারে কৃষিজমি ধ্বংস করে পুকুর খনন ও প্লট তৈরি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মহিনুল হাসান বলেন, কৃষিজমিতে পুকুর খনন বন্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কৃষিজমি কেটে আবাসিক প্লট করার বিষয়েও শিগ্গিরই পদক্ষেপ নেয়া হবে।