‘এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে বিএনপি চাঁদা তোলে না।’

রাজশাহীতে মুফতি ফয়জুল করিম
অনলাইন ডেস্ক: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম বলেছেন, ‘এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে বিএনপি চাঁদা তোলে না।’ রোববার বিকেলে রাজশাহীতে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজশাহী মহানগর শহরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। মুফতি ফয়জুল করিম বলেন, ‘আজকে বিএনপির চাঁদাবাজির অবস্থাটা কী? এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে চাঁদা তোলে না বিএনপি।
আমরা প্রতিদিন খবরের কাগজে দেখছি। এগুলো সামান্য। বরফের ওপরের অংশ যা দেখা যায়, নিচে তার চেয়ে অনেক বেশি থাকে। যতটুকু প্রকাশ পায়, তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি তারা চাঁদাবাজি করতেছে।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সমস্ত সম্পত্তি দখল করেছে কে? এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি কার কাছে? এস আলমের গাড়ি কার কাছে? খুঁজে দেখেন। আমার খোঁজার দরকার নেই।
আওয়ামী লীগের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা কারা ভারতে পাচার করেছে? খুঁজে দেখেন তো ভাল করে। তাহলে বুঝতে পারবেন কারা এইকাজগুলো করছে।’
‘চাঁদা নেয় পল্টনে, চলে যায় লন্ডনে’
ফয়জুল করিম বলেন, ‘২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত শুধু দেখেছি খাম্বা কেস। মনে আছে তো? কারেন্টের খাম্বা কেস। ট্রান্সফার কেস। হাওয়া ভবন। কত ভবন আমরা দেখেছি। এখন দেখছি, ৯ মাসে ১৫০ খুন। চাঁদা নেয় পল্টনে, চলে যায় লন্ডনে। শুনি, এটা আমার বক্তব্য না। এটা পাবলিক বলতেছে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মাজা কেন ভেঙেছিল, সেই প্রশ্ন তুলে ফয়জুল করিম বলেন, ‘আচ্ছা বলেন তো, আপনার নেতা এত ভাল, তা মিলিটারি কেন মাজা ভেঙে দিয়েছিল ওই সময়? রাগ করিয়েন না, এটা আমার কথা না।
যদি এতই ভাল ফেরেস্তা হয়, তো আর্মিরা মাজা ভেঙেছিল কেন? বিএনপির হাজারও নেতার মুখে এই বক্তব্য শুনেছি, “আমার লিডারের মাজা ভেঙে দিয়েছে। তারপরও লিডার এখনও আছে।” মাজা ভাঙছিল কেন? এই প্রশ্নের জবাব দিবেন?’
‘বিএনপিকে ভোট কেন?’
বিএনপিকে কেন মানুষ ভোট দেবে, সে প্রশ্ন তুলে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম বলেন, ‘আমাকে একটা বক্তব্য শোনান, যে বক্তব্যের কারণে বিএনপি ভোট নিবে। একটা ন্যারেটিভ আমাকে দেন।
একটা যুক্তি আমাকে প্লেস করুন, যে যুক্তির মানুষ বিএনপিকে ভোট দিবে। বিএনপি ১৯৯১-৯৬ ক্ষমতায় ছিল। যে বিএনপি ২০০১ থেকে ২০০৫ সালে ক্ষমতায় ছিল, সেই বিএনপি কেন ১৯৯৬ কিংবা ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসতে পারেনি কেন? বিপুল ভোটে হেরেছে কেন? বিএনপিকে ভোট দেয়ার একটা কারণ আপনি দেখাতে পারবেন না। যদি বলেন উন্নয়ন উন্নয়ন, এর চেয়ে হাজারগুণ বেশি উন্নয়ন করেছে আওয়ামী লীগ। হাজারগুণ বেশি।’
তিনি বলেন, ‘এরপরেও আওয়ামী লীগকে কেন মানুষ প্রত্যাখান করেছে? জুলুম, অত্যাচার, অবিচার, চাঁদাবাজি, গুণ্ডামি, মাস্তানি, মানুষের অধিকার করা, আজও বিএনপি সেই কাজটাই করছে।
জুলুম করছে, অত্যাচার করছে। আওয়ামী লীগ এত উন্নয়ন করার পরেও যদি দেশের মানুষ তাকে প্রত্যাখান করে, তাহলে আপনি তো ক্ষমতায় আসেন নাই, আপনাকে প্রত্যাখান করতে পারে না? এরজন্যই তো বিএনপি চায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক। বক্তব্য দিল- আওয়ামী লীগ ঠেকাও।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে সবার জবানের মধ্যে একটা স্লোগান উঠবে- বিএনপি ঠেকাও। ভেবেছেন, আগের কেচ্ছাকাহিনীতে ভোট করবেন?’
ফয়জুল করিম বলেন, ‘বিএনপি ভাবতেছে, বিগত ইতিহাস থেকে যে বিগত দিনে বিএনপি এত ভোট পেয়েছে, আগামীতেও এত ভোট পাবে।
তা বিগত দিনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ গঠন হয়েছে, এই দেশ স্বাধীন হয়েছে তারা ভারতে পালাইছে কেন? বিগত দিনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, আজকে ক্ষমতায় নাই কেন? বিগত দিনে বিএনপি ভোট পেয়েছে, আগামীতেও পাবেন সেই চিন্তায় আছেন, কেন মানুষ ভোট দিবে? ওই যে ভোলাতে স্বামীকে আবদ্ধ করে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করার জন্য?
কেন ভোট দিবে বিএনপিকে, আমাকে বলুন। ওই যে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় সমস্ত পুলিশদেরকে মারার জন্য? লুট করার জন্য? ভাঙচুর করার জন্য? আমি তো বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলি না। যারা সাংবাদিক আছেন, মিডিয়া আছে, তারা কথা বলে। আমি শুধু শুনাইয়া দিই।’
তিনি বলেন, ‘আজকে দেখেন, বিএনপির দুই গ্রুপে মারামারি করে সেখানে প্রায় তিনশোর ওপরে আহত হয়েছে। একজন মারা গেছে। প্রতিদিন হত্যা হচ্ছে। এই পর্যন্ত বিএনপি নিজেরা নিজেরা মারামারি করতে করতে দেড়শোর ওপরে খুন হয়ে গেছে। এখনও ক্ষমতায় যায় নাই। তাতেই যদি এই অবস্থা হয়, ক্ষমতায় গেলে অবস্থাটা কী হবে?’
‘আ.লীগকে আনতে চায় বিএনপি’
বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি বাগড়া দিয়েছে উল্লেখ করে ফয়জুল করিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা যাবে না, এই বক্তব্য সবচেয়ে বেশি বিএনপির।
বিএনপি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার জন্য, ইনক্লুসিভ নির্বাচনের সবচেয়ে বেশি বক্তব্য দিয়েছে এই বিএনপি। এখন প্রশ্ন করতে পারেন, আওয়ামী লীগকে কেন বিএনপি নির্বাচনে আনতে চায়? যেখানে বিএনপির প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ, সেখানে আওয়ামী লীগ না থাকলে তো বিএনপি পাস করবে।
তো আওয়ামী লীগকে তারা নির্বাচনে আনতে চায় কেন? চিন্তা করেছেন, কেন আনতে চায়? বিএনপির ভোট গ্রহণ করার জন্য তাদের বক্তব্যটা কি ছিল? আওয়ামী লীগ ঠেকাও। দাড়ি, টুপি, মসজিদ, মাদ্রাসা থাকবে না। ভারত হয়ে যাবে। এ ছাড়া বিএনপির মুখে আর কোন বক্তব্য শুনেছেন আজ পর্যন্ত?’
ইসলামী আন্দোলনকে ‘আওয়ামী লীগের দালাল’ বলার প্রতিবাদ জানিয়ে দলটির এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আজকে আমাদেরকে তারা বলে আমরা নাকি আওয়ামী লীগের দালাল। আমরা নাকি আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছি।
রাজনীতি করবেন, জেনেশুনে রাজনীতি কইরেন। বক্তব্য দিবেন, জেনেশুনে দিয়েন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, আজ পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ কোনো জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি।’
তিনি বলেন, ‘২০১৪-এর নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন অংশগ্রহণ করেনি। ’১৮-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, বিধায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তখনও গণভবনে যায় নাই।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিন্তু গণভবনে গিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলন অংশগ্রহণ করেছে, কিন্তু শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে নাই। ২০২৪-এর নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করেনি। বরং, ’১৮-এর নির্বাচন যেটা সবাই প্রত্যাখান করেছে, বিএনপি সেই অবৈধ সংসদে গিয়েছে। তারা আওয়ামী লীগের দালাল, নাকি আমরা দালাল?’
‘দেশের রাজনীতিতে দুই রেখা’
দেশের রাজনীতিতে দুটি রেখা স্পষ্ট জানিয়ে ফয়জুল করিম বলেন, ‘৯২ পার্সেন্ট মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। যদি আপনি মনে করেন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হয়, তাহলে এ দেশে তো মুসলমানের সরকার নির্বাচিত হওয়া উচিত ছিল।
অন্য কোন সরকার নির্বাচিত হওয়াটা অলীক ছিল। কিন্তু এখানে উল্টো হয়ে গেছে। এখন যে রাজনীতি চলছে। তা হলো- একটা ইসলামপন্থীদের রাজনীতি, আর ইসলামের বিপরীত রাজনীতি। দুইটা রেখা সৃষ্টি হয়ে গেছে অলরেডি।’
তিনি বলেন, ‘কেউ ইসলাম ঐকমত কায়েম করতে চায়, কেউ অ্যামেরিকান গণতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কেউ ভারতের পক্ষে, কেউ ভারতের বিপক্ষে। দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে বাংলাদেশ। দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে।
আগামী নির্বাচনে কী অবস্থা হবে? কারা ভোট পাবে? কথা ক্লিয়ার- যারা সুশাসন কায়েম করতে পারবে তারা ভোট পাবে। যারা সুশাসন কায়েম করতে পারবে না, তারা ভোট পাবে না। ক্লিয়ারকাট কথা।’
আগামীর দেশ হবে ইসলামের দেশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগামীর দেশে ইসলাম ক্ষমতায় যাবে, ইনশাল্লাহ। কোনো চোর, বাটপার, গুন্ডা, চাঁদাবাজ, মাস্তান এবং খুনিদেরকে এ দেশের মানুষ আর ক্ষমতায় নেবে না। যেখানে জুলুম থাকবে না।
অত্যাচার, অবিচার, খুন, লুট, চাঁদা থাকবে না, খুন হবে না, গুম হবে না। মা-বোনেরা রাস্তায় নামবে, ইজ্জতহানি হবে না। বাংলাদেশের এই জনগণ গোলামি চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না।’
‘কুদরতি হাতপাখা’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের দলীয় প্রতীককে ‘কুদরতি পাখা’ উল্লেখ করে মুফতি ফয়জুল করিম বলেন, ‘হাতপাখা, আল্লাহ কুদরতি এক পাখা দান করেছেন আমাদেরকে, আল্লাহপাক।
কীভাবে? যারা নৌকা নির্বাচন করে, তারা নিজেরা নৌকা চালাতে পারে না। যারা ধানের শীষে নির্বাচন করে, তারা নিজেরা ধান কাটতে পারে না। যারা লাঙল নিয়ে নির্বাচন করে, নিজেরা লাঙল দিতে পারে না।
যারা গরুর গাড়ি নিয়ে নির্বাচন করে, নিজেরা গরুর গাড়ি চালায় না। হাতপাখা এমন এক প্রতীক, যে নির্বাচন করে সে ঘুরাতে পারে। পুরুষ, মহিলা, ছোট, বুড়োরাও চালাতে পারে।
হাতপাখার প্রয়োজন হিন্দুদের, খ্রিস্টানদের, মুসলমানদের। কেউ তাদের প্রতিক নিয়ে ঘুমায় না। মানুষ হাতপাখা বুকের ওপর নিয়ে ঘুমায়। কারেন্ট ফেইল করে, কিন্তু হাতপাখা ফেইল করে না। তাই হাতপাখার দরকার।’
‘আসুন না, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে। আগামীতে যদি ইসলামের পক্ষে একটা বাক্স করতে পারি, তাহলে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকেন, আগামীতে ইসলাম ক্ষমতায় থাকবে, কেউ ফেরাতে পারবে না।
সকল মার্কা দেখা শেষ, হাতপাখার মার্কা শেষ। সকল আদর্শ দেখেছি, এবার ইসলামী আদর্শ দেখতে চায়। চোর, ডাকাত, বদমাইশদের মাধ্যমে এই দেশ কখনও দুর্নীতিমুক্ত হতে পারে না।
যে দলের মধ্যে চাঁদাবাজ, ধর্ষণ, খুনি আছে, ওদেরকে ভোট দেবেন না। যদি আমার দলের মধ্যে চাঁদাবাজ, খুনি, ধর্ষণ থাকে-প্রত্যাখান করুন। ওদেরকে ভোট দেবেন না। যদি প্রত্যাখান করেন, দুর্নীতিবাজরা আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না।’
‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের ঐক্য ভাবনা উলামায়ে কেরাম ও তাওহীদি জনতার করণীয়’ শীর্ষক এই মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি শেখ মুহাম্মদ নুরুন নাবী। সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী মহানগরের সভাপতি অধ্যক্ষ মাওলানা হোসাইন আহমদ।