ঢাকা | জুলাই ২৫, ২০২৫ - ৬:৫৯ অপরাহ্ন

শিরোনাম

আশুরা: ইতিহাস, তাৎপর্য ও ফজিলত

  • আপডেট: Saturday, July 5, 2025 - 1:54 am

মোহাম্মাদ মাকছুদ উল্লাহ: বছর ঘুরে আবার এলো মহররম। মুসলিম বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এটি। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমার ফারূক (রা.) রাসুলে কারিম (সা.) এর ঐতিহাসিক মদিনা হিজরতকে স্মরণীয় করে রাখতে হিজরি সনের প্রবর্তন করেন। তাই হিজরি সনের প্রথম মাস হিসেবে মহররম মাস মুসলিম জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু হিজরি সনের প্রথম মাস হওয়াটাই মহররম মাসের গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। বহুবিধ উপকরণের সম্মিলন মহররমকে এক অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। আর শুধুই যে মুসলিম সমাজে মাসটি বিশেষ মর্যাদায় স্মরণ করা হয় তাও নয়। বরং ইহুদি-নাসারা এবং জাহেলি যুগের আরবরাও মাসটিকে বিশেষ মর্যাদার সাথে স্মরণ করেছে।

হাদিসের বিবরণ থেকে জানা যায়, মহররম মাসটি মহান আল্লাহর দরবারে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। জাহেলি যুগের আরবরা মাসটিকে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে দেখতো। তাই তারা এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ বলে জানতো।

মহররম’ একটি আরবি শব্দ, এটির আভিধানিক অর্থ নিষিদ্ধ। জাহেলি আরবে মহররম মাসের মর্যাদা রক্ষায় এতে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ এমন সামাজিক প্রবন চালু থাকলেও বর্বরতার করাল গ্রাসে তাদের নৈতিক অধপতন এতোই মারাত্মক পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল যে, তারা তাদের প্রতিশোধ পরায়নতা চরিতার্থ করতে কখনো কখনো মহররম মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হতো।

আর মহররম মাসের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষার্থে অন্য কোন মাসে তারা যুদ্ধ বিরতি পালন করতো। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের পরে মহররম মাসসহ চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এবিষয়ে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছে, “ইন্না ইদ্দাতাশ-শুহুরি ইন্দাল্লাহিসনা আশারা শাহরান ফী কিতাবিল্লাহ।

মিনহা আরবাআতুন হুরুম ফালা-তাজলিমূ ফীহিন্না আনফুসাকুম…..” অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সাল গণনার মাস ১২টি, তম্মধ্যে চারটি হলো নিষিদ্ধ মাস, আর এটইি সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এগুলির বিষয়ে নিজেদের ওপর জুলুম করো না। (সূরা আত-তাওবাহ: ৩৬) পবিত্র  কোরআন ঘোষিত নিষিদ্ধ চারটি মাস হলো জিলক্বদ, জিলহাজ্ব, মহররম ও রজব।

মহররম মাসের দশ তারিখ মুসলিম সমাজে আশুরা নামে খ্যাত। আশুরা আরবি শব্দটি আশরুন শব্দমূল থেকে গঠিত হয়েছে। আর আশরুন এর আভিধানিক অর্থ দশ ও আশুরার আভিধানিক অর্থ দশম। বস্তুত: আলোচ্য দিনটি মহররম মাসের দশম দিন বলেই একে আশুরা বলা হয়। এই আশুরাকে কেন্দ্র করে মুসলিম উম্মাহ গভীর ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতিতে আপ্লুত হয়। আমরা বক্ষমান নিবন্ধে আশুরার ইতিহাস, তাৎপর্য ও ফজিলত নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াস পাবো।

আশুরার ইতিহাস: আশুরা’ হলো সেই দিন, যে দিনে মহান আল্লাহ সৃষ্টির শূন্যতা ঘুচিয়ে লওহ-কলম, আসমান-যমীন সৃষ্টি করেন। এদিনেই হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়। অতঃপর তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়।

জান্নাতে হযরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর অবস্থানের ময়াদকাল শেষ হলে আবার একই দিনে তাঁদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। আশুরার দিনে হযরত নূহ (আ.) মহাপ্লাবন শেষে আবার পৃথিবীতে অবতরণ করেন। জালিম শাহী-নমরুদের বিদগ্ধ অগ্নিকুন্ডে মুসলিম উম্মাহর পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে মহান আল্লাহ নিরাপদে হিফাজত করেছিলেন এই আশুরার দিনে।

হযরত আইউব (আ.) দীর্ঘ ১৮ বছর রোগভোগের পর সুস্থতা লাভ করেছিলেন এই আশুরার দিনে। হযরত ইউনুস (আ.)-কে মহান রাব্বুল আলামীন মাতৃগর্ভ থেকে নাজাত দিয়েছিলেন আশুরার দিনে। দীর্ঘদিন পরে হযরত ইউসুফ (আ.) ও তাঁর পিতা ইয়াকূব (আ.)-এর সাক্ষাৎ ঘটেছিল আশুরার দিনে। হযরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন আশুরার দিনে।

আবার খোদাদ্রোহীদের হত্যার ষড়যন্ত্র থেকে স্বীয় নবীকে রক্ষা করতে মহান আল্লাহ হযরত ঈসা (আ.)-কে আসমানে তুলে নিয়েছিলেন এই আশুরার দিনে। হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারী ৬ লক্ষাধিক বনি ইসরাঈলকে মহান আল্লাহ মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফিরাউন ও তার সাঙ্গপাঙ্গকে নীলনদে ডুবিয়ে সলিল সমাধি করেছিলেন এই আশুরার দিনে। তবে উপরোক্ত ঘটনাবলির অধিকাংশই দুর্বল বা জাল সনদ দ্বারা বর্ণিত বলে মুসলিম বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

তবে আশুরাকে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা মুসলিম মানসে বিশেষ বেদনা ও প্রেরণায় উদ্বেলিত করে। ৬১ হিজরির ১০ মহররম তারিখে ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে ঘটে যাওয়া বিয়োগাত্মক ঘটনা আশুরার অতীতের সকল ইতহাসকে ছাপিয়ে মুসলিম হৃদয়ে মারাত্মক এক ক্ষতচিহ্ন একে দিয়েছে।

এদিনে জালিমশাহীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক মহানবী (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত হুসাইন (রা.) সহ নবী পরিবারে ১৮ জন সদস্য মিলে মোট ১৩০ জনের নির্মম শাহাদাত ইসলামের ইতিহাসকে  নতুন বাকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। নিরিহ-নিরস্ত্র হযরত হুসাইন তাঁর শাহাদাতের বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ভবিষ্যৎদ্বাণী সম্পর্কে অবগত ছিলেন।

তিনি কুফাবাসীর বিশ্বাস ঘাতকতা প্রত্যক্ষ করার পরও বিশিষ্ট সাহাবায়ে কিরাম এবং আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শ উপেক্ষা করে মর্মান্তিক পরিণতি বরণ করে নিয়েছিলেন শুধু নিজের ঈমানি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে রাসুলে কারীম (সা.) এর রেখে যাওয়া খেলাফত ব্যবস্থাকে রক্ষার জন্য।

বিভিন্ন প্রলোভন আর হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে হযরত হুসাইন (রা.) ইয়াজিদের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটিয়ে ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন এই অপরাধে জালিম ইয়াজিদ এর অভিশপ্ত বাহিনী জান্নতি যুবকদের সর্দার হযরত হুসাইন (রা.), আহলে বাইতের ১৮ জন মহান সদস্যসহ মোট ১৩০জন প্রতিবাদি জনতাকে পৈচাশিক নির্যাতনের মাধ্যমে শহিদ করে।

সেই থেকে আশুরা মুসলিম সমাজে জুলুম-নির্যাতন আর অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্মারক হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বছর ঘুরে আসা আশুরার দিনে তাই আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ইনসাফের পক্ষে ও সকল জুলুম-নির্যাতন ও শ্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।

আশুরার ফজিলত: আশুরার দিনটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। জাহেলি যুগের লোকেরাও এদিনে রোযা পালন করতো। ইসলামী পন্ডিতগণের অনেকেরই অভিমত, দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগ পর্যন্ত আশুরার রোজা মুসলমানদের ওপর ফরজ ছিলো, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পরে আশুরার রোজার ফরজ বিধান রহিত করা হয়েছে।

সে মতে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা.) রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগ পর্যন্ত আবশ্যিকভাবে আশুরার রোজা পালন করতেন। অতঃপর রমজানের রোজা ফরজ হবার পর আশুরার রোজা নফল তথা ঐচ্ছিক বিধানের আওতায় চলে আসায় যার ইচ্ছা তিনি আশুরার রোজা রেখেছেন আর যার ইচ্ছা তিনি রাখেন নাই। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরত করে মক্কা থেকে মদীনা আসার পরে দেখতে পেলেন, সেখানকার ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা পালন করে। তাদেরকে এদিনে রোজা রাখার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বললো, এদিনে আল্লাহ হযরত মুসা (আ.) ও বনি ইসরাঈলকে ফিরাউন ও তার সম্প্রদায়ের ওপর বিজয়ী করেছিলেন, তাই আমরা এদিনে রোজা পালন করি। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমরা তোমাদের অপেক্ষা হযরত মুসার উত্তম অনুসারী।

অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কিরামকে আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দেন। (সহীহ আল-বোখারী) অপর এক হাদীস থেকে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার রোজা সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামকে বলেছেন, তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং এবিষয়ে ইহুদি ও নাসারাদের বিপরিত আমল করো।

অতএব তোমরা আশুরার দিনের পূর্বে একদিন অথবা পরে একদিন যুক্ত করে (৯-১০ অথবা ১০-১১ মহররম) দুইদিন রোজা রাখো।

আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) এক হাদীসে বলেছেন, আমি আশা করি এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী এক বছরের গুণাহ মাফ করে দিবেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, ফরজ নামাজের পরে উত্তম নামায কোনটি? আর রমজান মাসের রোজার পরে উত্তম রোজা কোনটি? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ফরজ নামাজের পরে উত্তম নামাজ হলো মধ্যরাতের নামাজ (তাহাজ্জুদ নামাজ) আর রমজান মাসের রোজার পরে উত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

লেখক: পেশ ইমাম ও খতীব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ।