চাঁপাইয়ে দড়ির তৈরি আসবাব দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও

চাঁপাই ব্যুরো: দড়ির খাট, শোফা, মাইচা, ওয়ারড্রপ, চেয়ারসহ দড়ির তৈরি বিভিন্ন রকম ফার্নিচারের কদর ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘সুন্দর’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
তাদের দড়ির তৈরি নিখুঁত বনুনের খাট এবং সোফা’র চাহিদা এখন দেশের বাইরেও বাড়ছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এমনকি আমেরিকাতেও যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের দড়ির তৈরি নানা ফার্নিচার।
তবে এর শুরু হয়েছিল নিছক নিজের ঘর সাজানো দিয়ে। জামালপুরের মেয়ে সাবিহা আফসানাকে বিয়ে করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা শহরের প্রফেসর পাড়া আব্দুস সালাম শ্যামল। হাই কমিউনিকেশন্স ফার্মের কাজ করতেন তিনি। নিজের ড্রয়িংরুম সাজাতে গিয়ে দড়ির খাট নজর কাড়ে আফসানার।
জেলার ঐতিবাহী এই আসবাব ঠাঁই পায় তার ড্রয়িংরুমে। এরপর তা নজর কাড়ে তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও ব্যবসায়ীক অংশীদারদের।
দড়ির তৈরি খাট, শোফা, মাইচা, চেয়ার কেনার আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। রাজধানীর বনানী, উত্তরা, বারিধারা, গুলশানের মতো অভিজাত এলাকার ড্রয়িংরুমেও ঠাঁই পেয়েছে তাদের ফার্নিচার। রাজধানীতে ফার্নিচারের সাড়া পেয়ে খোলেন ‘সুন্দর’ নামে অনলাইন একটি পেজ। এবার চাহিদা পেতে থাকেন দেশ-বিদেশ থেকে।
চাহিদা বাড়তে থাকায় সাত-আট মাস আগে একটি কারখানা গড়ে তোলেন শ্যামল। এখন প্রতিদিন বিলুপ্তপ্রায় এবং পরিবেশবান্ধব দড়ির খাট, শোফা, মাইচা, ওয়ারড্রবসহ বিভিন্ন ধরনের ফার্নিচার সরবরাহের অর্ডার পাচ্ছেন তিনি। ‘
সুন্দর’ প্রতিষ্ঠানের ফাউন্ডার আব্দুস সালাম শ্যামল বলেন, তাদের পেজে এসব ফার্নিচারের ক্যাটালগ দেখে ঢাকার অভিজাত পরিবারের গন্ডি পেরিয়ে এখন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশেও চাহিদা বাড়ছে। তিনি বলেন, ৪ ফুট বাই দেড় ফুট মিনি সাইজের দড়ির খাট ৭ থেকে ১০ হাজার টাকায় এবং সাড়ে ৫ ফুট বাই ৩ ফুটের বড় সাইজের দড়ির খাট ৮-১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দড়ির তৈরি খাটের ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের। ধারণা করা যায়, আরব অঞ্চল থেকে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত এই দড়ির খাটলা এসে পৌঁছায়। মরক্কোর পর্যটক ও পণ্ডিত ইবন বতুতা যখন তুর্কি সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের দরবারে যোগ দিতে এই উপমহাদেশে আসেন, তখন তিনি অনেক ভারতীয় বিষয়ে বিস্মিত হন। এগুলোর মধ্যে ছিল নৃত্য ও সংগীত, রাজকীয় ভোজ, পান, নারিকেল ও আম এবং ভারতীয় খাট। ১৩৫০ সালে তিনি লিখেছিলেন, “ভারতে খাটগুলো খুবই হালকা।
একজন মানুষ সহজেই এটি বহন করতে পারে এবং প্রতিটি ভ্রমণকারীর নিজের একটি খাট থাকা উচিত, যা তার দাস মাথায় করে বহন করে। এই খাটে চারটি শঙ্কু আকৃতির পা থাকে, যার ওপর চারটি কাঠের দণ্ড বসানো হয়; মাঝখানে রেশম বা সুতি ফিতের মতো কিছু দিয়ে বোনা হয়। এতে শুয়ে পড়লেই আর কিছু লাগেনা-খাটটিই যথেষ্ট নমনীয় হয়ে ওঠে। ধারণা করা হয় দড়ির তৈরি খাটের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
বর্তমানে উন্নতমানের বাবলা, মেহগনি ও সীসা কাঠের খোড়া এবং সাইড পাশি দিয়ে ৫০ ধরণের ডিজাইনে নানা ফার্নিচার তৈরি করা হচ্ছে। এসব ফার্নিচার ভবিষ্যত ব্যবহারে স্থায়িত্বকাল বেশি।
এগুলো পরিবেশবান্ধব এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিমুক্ত। শ্যামল বলেন, দড়ির তৈরি ফার্নিচারের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করাই মূল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে প্রতিদিনই ব্যাপক সাড়া মিলছে। আর খুব শিগগির বিদেশিদের অর্ডারকৃত ফার্নিচার পাঠানোর শেষ প্রক্রিয়া চলছে।
শ্যামল আরও বলেন, নতুন ধারার কাঠমিস্ত্রি ও অভিজ্ঞ ডিজাইনাররা নিখুঁত দড়ির বনুন দিয়ে প্রাণ সঞ্চারিত করে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য দড়ির খাটের প্রতি ভোক্তাদের নজর কাড়ছেন।
তাই প্রতিদিনই নতুন নতুন অর্ডার আসছে ‘সুন্দর’ নামে এই প্রতিষ্ঠানে। আর এখন কারখানায় ১৫-২০ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আর আগামীতে ঢাকার অভিজাত এলাকায় ‘সুন্দর’ নামে এই প্রতিষ্ঠানের শোরুম খোলার চিন্তা-ভাবনা চলছে।