ঢাকা | জুন ২৫, ২০২৫ - ৭:০০ অপরাহ্ন

ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র কে আসল বিজয়ী?

  • আপডেট: Tuesday, June 24, 2025 - 11:43 pm

সোনালী ডেস্ক : কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির চেষ্টার আগেই ইরান এই সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছিল।

সোমবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলার বিষয়ে আলোচনার জন্য ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল জরুরি বৈঠকে বসে। সপ্তাহব্যাপি ইসরায়েলি হামলায় ইরানের সামরিক নেতৃত্ব ও অবকাঠামো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় আমেরিকার বোমাবর্ষণ দেশটির জন্য আরও বড় আঘাত হিসেবে আসে।

এমন পরিস্থিতিতে ইরানের জন্য মুখরক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়ে। এক বাঙ্কারের ভেতর থেকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি পাল্টা হামলার নির্দেশ দেন বলে যুদ্ধ পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চারজন ইরানি কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

ওই কর্মকর্তাদের মতে, আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এই নির্দেশের সঙ্গে আরও একটি বার্তা দেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যাতে পুরোমাত্রার যুদ্ধ এড়ানো যায়, সেজন্য প্রতিশোধের মাত্রা সীমিত রাখার পরামর্শ দেন তিনি। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশে রাজি হননি ইরানের যুদ্ধ পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তারা।

তারা বলেছেন, ইরান এই অঞ্চলে যেকোনও একটি মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে চেয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি পাল্টা হামলা যেন না হয় সেদিকেও সতর্ক ছিল তেহরান। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) দুই সদস্যের মতে, যে কারণে আইআরজিসি আল উদেইদ বিমান ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নেয়।

এই সিদ্ধান্তের পেছনে দু’টি কারণ ছিল। ওই দুই সদস্য বলেন, এটি এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি এবং এখান থেকেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বি-২ বিমানের হামলার সমন্বয় করা হয়েছিল বলে তারা মনে করেন। যেহেতু এই ঘাঁটি ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র কাতারে অবস্থিত, তাই ইরানি কর্মকর্তারা হামলার ক্ষয়ক্ষতি সীমিত রাখা সম্ভব হবে বলে ধারণা করেন। হামলার কয়েক ঘণ্টা আগেই ইরান একাধিক মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে আগাম বার্তা পাঠাতে শুরু করে।

কাতার নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ এবং আমেরিকানদের সতর্ক করে দেয়। দেশের জনগণের কাছে ইরান এই হামলাকে আমেরিকার হামলার মাশুল হিসেবে তুলে ধরে। টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেন, কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে আইআরজিসি।

আমরা আমাদের শত্রুদের সতর্ক করে দিচ্ছি, আঘাত করে পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পাওয়ার যুগ শেষ। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে কাতারের আকাশে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আগুনের ফুলকির দৃশ্য প্রচার করা হয়। উপস্থাপকরা নাটকীয় ভঙ্গিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ইরানের গৌরব ও বিজয়ের কথা বলেন।

ওই চার কর্মকর্তা বলেন, পর্দার আড়ালে ইরানের নেতারা তাদের সীমিত হামলা ও আগাম সতর্কবার্তা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সংযত হতে রাজি করাবে বলে প্রত্যাশা করেছিলেন; যাতে ইরানও পিছু হটতে পারে।

পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগেই ইরানে শুরু করা বোমা হামলা বন্ধ করতে ইসরায়েলকে ওয়াশিংটন চাপ দেবে বলেও প্রত্যাশা করেছিলেন তারা। তেহরানের বাসিন্দারা বলেছেন, সোমবার রাত পর্যন্ত ইরানে ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত ছিল।

কাতারে মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলার আগে ইরানি এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, পরিকল্পনাই ছিল এমন যে, কোনও মার্কিন নাগরিক যেন নিহত না হন। কারণ কারও প্রাণহানি ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়া আসার সম্ভাবনা ছিল। যা চক্রাকারে হামলা-পাল্টা হামলার মতো পরিস্থিতির দিকে যেতে পারতো।

এই পরিকল্পনা কাজ করেছে বলে মনে হচ্ছে। পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, আল উদেইদ ঘাঁটিতে ইরানের ছোড়া ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্রের ১৩টিই প্রতিহত করা হয়েছে। কোনও মার্কিন নাগরিক নিহত কিংবা আহত হননি এবং সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এক বিবৃতিতে ট্রাম্প বলেন, আগাম সতর্কবার্তা দেওয়ায় কোনও প্রাণহানি কিংবা আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি।

এজন্য ইরানকে ধন্যবাদ জানাই।  তিনি বলেন, তাদের সক্ষমতার পুরোটাই ব্যবহার করেছে এবং আশা করি ঘৃণার জায়গা থেকে আর কিছু হবে না। এর কিছুক্ষণ পর ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আসন্ন। তবে মঙ্গলবার সকালেই তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ট্রাম্প ইরান ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতির শর্ত না মানার অভিযোগ তোলেন।

এর আগে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানবিষয়ক পরিচালক আলি ভায়েজ বলেন, এখন প্রত্যেক পক্ষই নিজেদের বিজয় দাবি করতে পারছে। পাশাপাশি ভয়াবহ পরিণতির বৃহত্তর সংঘাত এড়াতেও সক্ষম হয়েছে।

‘‘যুক্তরাষ্ট্র বলতে পারে, তারা ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমে ধাক্কা দিয়েছে। ইসরায়েল বলতে পারে, তারা আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে দুর্বল করেছে। আর ইরান বলতে পারে, তারা টিকে আছে এবং অনেক শক্তিশালী সামরিক শক্তির মুখোমুখি হয়ে প্রতিরোধ গড়েছে।’’ মাত্র এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময়ে এই যুদ্ধ একাধিক ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের প্রতি ইরানের আগ্রহ কমে আসছিল।

ইরানের বেশিরভাগ নাগরিক জাতীয় পতাকার তলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং এই যুদ্ধকে তাদের দেশের ওপর আক্রমণ বলে নিন্দা জানিয়েছে। যদিও হাজার হাজার মানুষ তেহরানসহ অন্যান্য শহরে গৃহহীন হয়ে পড়েছে। দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি বিভিন্ন অফিস বন্ধ কিংবা স্বল্প সময় চালু ছিল।

অর্থনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছিল ট্যাক্সিচালক, শ্রমিক, পরিষেবা কর্মীসহ অনেকে বলছিলেন, এভাবে চললে তারা আর বেশিদিন টিকতে পারবেন না।

তেহরানের জাতীয় উন্নয়ন পার্টির প্রধান সাদেক নোরৌজি বলেন, ‘‘আমাদের দেশ এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা রাখে না। আমাদের অর্থনৈতিক সঙ্কট আছে, জনসমর্থন ধরে রাখা কঠিন। আর আমাদের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আমেরিকা ও ইসরায়েলের মতো নয়।’’

এমনকি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকেও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান আসতে শুরু করে। বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক করিম জাফারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে মনোযোগ দেওয়া উচিত ইরানের; যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নয়।

এই মুহূর্তে পরিণতি বিবেচনা না করেই একটি বহুমুখী যুদ্ধ শুরু করাটা ইরানের জন্য সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় বিষয়। এরপর ইরান কী করবে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সীমিত আক্রমণ হয়তো বড় যুদ্ধ এড়ানোর কৌশল। কিন্তু তা যে শত্রুতা পুরোপুরি শেষ হওয়ার ইঙ্গিত, বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়।

পশ্চিমা কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর মার্কিন হামলার পরও ইরানের ইউরেনিয়াম মজুদের বর্তমান পরিস্থিতি কী, সেটা নিয়ে তারা নিশ্চিত নন।  ইরানের কি আরও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সক্ষমতা রয়েছে? তারা কি আরও গোপনীয় পথে হাঁটবে? নাকি এখন ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনায় আসবে?

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি কূটনৈতিক সফরে তুরস্ক, রাশিয়া ও তুর্কমেনিস্তানে গেছেন। কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ওপর ইরানের হামলার পর তিনি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার দেশের বিরুদ্ধে শুরু করা যুদ্ধ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ‘‘আমি বলছি না তারা আমাদের ক্ষতি করেনি। হ্যাঁ, ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তারা তাদের মূল লক্ষ্য আমাদের সব সক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া কিংবা অন্য কোনও কৌশলগত উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারেনি।’’

Hi-performance fast WordPress hosting by FireVPS