ঢাকা | জুন ২৩, ২০২৫ - ৫:৪৬ অপরাহ্ন

কেন ওটিটি সিরিজ টিভি নাটককে ছাড়িয়ে যাচ্ছে?

  • আপডেট: Monday, June 23, 2025 - 12:50 pm

অনলাইন ডেস্ক: টিভি নাটকে এক সময় ঘরোয়া জীবনের আবেগ ও পারিবারিক গল্পের পাশাপাশি, প্রেম-ভালোবাসা, মান-অভিমানের বিষয়গুলো উঠে আসত।

কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষপটে নাটকে ঘুরেফিরে এক প্যাঁচালেই আটকে থাকছে কাহিনি। দর্শকদের বড় একটি অংশ এ ধরনের নাটকে এখন ক্লান্ত। তাদের চোখ এখন খুঁজে ফেরে ভিন্নমাত্রার গল্প, বাস্তবতাকে তুলে ধরার সাহস এবং কারিগরি উৎকর্ষ।

দর্শকদের এ চাহিদা পূরণে এগিয়ে এসেছে ওটিটি কনটেন্টগুলো। অ্যাপ্সভিত্তিক বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও ইউটিউব প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত কনটেন্টে সবাই এখন গল্পে বৈচিত্র্য আনতে আগ্রহী। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই এসেছে ফরম্যাটের এ পরিবর্তন।

সাধারণত টিভিতে প্রচারিত একক নাটক ৩০-৫০ মিনিটের হয়ে থাকে, ধারাবাহিক নাটক ৫০-এর বেশি পর্বের হতেও দেখা গেছে। এসব নাটকে দেখা যায় ঘুরে ফিরে একই গল্প। তাতে থাকে কমেডি ঘরানার আধিক্য। কাতুকুতু দিয়ে দর্শক হাসানোর প্রতিযোগিতা।

এদিকে ওটিটি সিরিজে এক সিজনে থাকে ২০-৪০ মিনিট দৈর্ঘ্যরে একাধিক পর্ব। সেগুলোর গল্পে থ্রিলার, সামাজিক বাস্তবতা, মনস্তাত্ত্বিকতা, অপরাধ, ডার্ক কমেডি প্রাধান্য পায়। কাহিনি জটিল, চরিত্র অনেক গভীর এবং একাধিক সাব-প্লট থাকে। এ

সব কনটেন্ট দর্শক সাবস্ক্রিপশন অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে দেখেন। তাই গল্পের মান, নির্মাণশৈলী, অভিনয়-সবকিছুর মান উন্নয়ন বাধ্যতামূলক। দর্শক এখন আর টিভি অন করে নাটক খোঁজেন না, খোঁজেন ‘কোন গল্পটা দেখতে মন চায়’। এ চাহিদাই নির্মাতাদের বাধ্য করছে নতুনভাবে ভাবতে। তাই পছন্দের তালিকায় টিভি নাটক থেকে ওয়েব সিরিজ একধাপ এগিয়ে রয়েছে বলেও অনেকে মনে করছেন।

তবে টিভি নাটক এখনো শহরের বাইরে, মধ্যবয়সি দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয়। কিন্তু নগর ও তরুণ দর্শকদের বড় অংশ এখন ওয়েবে যুক্ত। টিভি নাটকের জনপ্রিয়তাকে পাশ কাটিয়ে ওয়েব সিরিজগুলো দর্শক আগ্রহে আসার পেছনে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কারণও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিভি নাটকের গল্পে একঘেয়েমি, অল্প সময়ে নির্মাণ, বিজ্ঞাপনের জন্য নাটকে কাটাছেঁড়া-এ সবই মানহীন নাটক বাড়িয়ে দিয়েছে; যা দর্শক বিমুখতার অন্যতম কারণ। পাশাপাশি ওয়েব সিরিজে স্বাধীনভাবে গল্প বলার স্বাধীনতায় দর্শক আগ্রহ বাড়াচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে একাধিক নাট্যনির্মাতা জানান, টিভি চ্যানেলকে খুশি করতে গিয়ে অনেক সময় গল্পের মান নষ্ট হয়ে যায়। সময় নেই, বাজেট নেই, তবু নাটক করতে হয়। এটা কাজ নয়, শুধু যেন দেনা শোধ করা মাত্র।

এদিকে প্রত্যেকটা নাটক বানানোর সময় আরও একটি বিষয়ও মাথায় রাখতে হয়, বিজ্ঞাপনদাতার পছন্দ কী, সময়সীমা কতটুকু, টিভি প্রিভিউ কমিটি কতটা কাঁচি চালাবে। এসব সীমাবদ্ধতায় শিল্পের স্বাধীনতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

টিভি নাটকের এ ক্রান্তিকালের মধ্যে ওটিটি যেন নতুন আশা সঞ্চার করছে। ওয়েব সিরিজগুলো যেমন দর্শক টানছে, তেমনই নির্মাতাদেরও দিয়েছে গল্প বলার স্বাধীনতা। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আসার পর থেকে আরও একটি বিষয় ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে।

নতুন মুখের আবির্ভাবে প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে এ মাধ্যমটি। টিভি নাটকে যারা সুযোগ পেতেন না, তারাই এখন ওয়েবে জনপ্রিয়। বিশেষত চিত্রনাট্যকারদের স্বাধীনতা, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করার সীমাবদ্ধতা না থাকায় গল্পের গভীরে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছেন তারা।

এদিকে ওটিটির সুসময়ের মধ্যে এটি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ওয়েব কনটেন্টগুলোতে ‘স্বাধীনতা’র নামে কিছু কনটেন্টে অশ্লীলতা ও অপ্রয়োজনীয় যৌন ইঙ্গিতের ব্যবহার দর্শকদের একাংশের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে সেন্সর নীতিমালারও দাবি।

বিশ্লেষকরা বলেন, ‘ওয়েব সিরিজ সাহসী হোক, তবে শালীনতার সীমা অতিক্রম না করাই শ্রেয়। সাহসী গল্প বলার স্বাধীনতা থাকা উচিত, তবে তা যেন সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। না হলে এই মাধ্যমও একদিন দর্শক হারাবে।’

এ প্রসঙ্গে অভিনেতা ও নির্মাতা আফজাল হোসেন বলেন, ‘নাটকের মাধ্যম বদলেছে, তবে গল্প বলার দায় কিন্তু বদলায়নি। ওয়েবে স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সে স্বাধীনতাকে শিল্পে রূপ দেওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ।

সেই চ্যালেঞ্জ উতরে বেশ কিছু ভালো কনটেন্ট আসছে। কিন্তু সামাজিক দায় বোধ থেকে সরে গেলেও চলবে না। নতুন ফরম্যাটে গল্প বলতে গিয়ে আমরা যেন অতিরঞ্জিত কিছু না করি। যা আমাদের ক্ষতির কারণ হয়।’

অভিনেতা জাহিদ হাসান বলেন, ‘টিভি নাটক এখনো সব শ্রেণির মানুষের জন্য। ওয়েব সিরিজ শহুরে দর্শকের জন্য দারুণ, কিন্তু আমরা ভুলে যাই, ঢাকার বাইরেও দর্শকদের বড় একটি অংশ আছে। এটা ঠিক গল্প বলার ধরন দুটোর আলাদা। দুটিই আমাদের বিনোদনের খোরাক দিচ্ছে। তাই এর অবস্থান সমান পর্যায়ে রয়েছে বলেই মনে করি।’

বিষয়টি নিয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম বলেন, ‘টিভি নাটকে এখন সময় নেই, ধৈর্য নেই। ওটিটিতে চরিত্র নিয়ে কাজ করার সময় পাওয়া যায়। কিন্তু সেন্সরের অভাবে কিছু নির্মাণ অতিরিক্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। গল্প বলার ঢংয়ে আনে পরিবর্তন। তবে তাদের নিজস্ব একটা স্টাইল রয়েছে। যেটি টিভি নাটকের সঙ্গে মেলানো কঠিন।’

জাকিয়া বারী মম বলেন, ‘ওটিটিতে কাজের পরিসর বেড়েছে, চরিত্রে গভীরতা আনার সুযোগ আছে। টিভি নাটকে এমন সুযোগ কম। তবে সবার আগে দরকার ভালো গল্প।

আর এটি বলার মতো সুযোগ ও সময় প্রয়োজন। তাই ওয়েবের গল্প বলার ধরন একটু আলাদা। এখানে যথেষ্ট সময় নিয়ে কাজ করা যায়।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওয়েব সিরিজ ও টিভি নাটক একে অপরকে প্রতিযোগী নয়, বরং পরিপূরক করে তুলতে পারে। পরিবারকেন্দ্রিক গল্প ও জাতীয় দিবসভিত্তিক নাটকে এখনো টেলিভিশন অপরিহার্য।

অন্যদিকে যুগোপযোগী গল্প তুলে ধরতে ওয়েব মাধ্যমের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের নাটকের ফরম্যাটে এ পরিবর্তন সময়ের দাবি ছিল। টিভি নাটকের অতীত গৌরবকে অস্বীকার না করেই ওয়েব সিরিজের স্বাধীন সৃজনধারা আগামী প্রজন্মের নাট্যভাষা গড়ছে।

Hi-performance fast WordPress hosting by FireVPS