জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা কিছু ভিন্নমতসহ এনসিসির পক্ষে জামায়াত-এনসিপি, বিপক্ষে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল

সোনালী ডেস্ক: রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
গতকাল বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার দ্বিতীয় দিনের আলোচ্যসূচিতে এনসিসির বিষয়টি ছিল। বিএনপি বরাবরের মতো গতকালও এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করেছে।
আলোচনায় বিএনপির সমমনা ১২ দলীয় জোটও এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ পার্টিসহ (এবি পার্টি) কয়েকটি দল এনসিসি গঠনের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে তারা এনসিসির গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছু ভিন্নমতের কথা বলেছে।
সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়।
গত ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন। প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হলেও মৌলিক সংস্কারের কিছু প্রস্তাব নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি।
যেসব প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়নি, সেগুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ২ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা। পরের দিন বিষয়ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে দ্বিতীয় পর্যায়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। তিনটি বিষয়ে (সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনয়ন ও নারী প্রতিনিধিত্ব) আলোচনার পর ওই দিন অধিবেশন মুলতবি করা হয়।
সেই মুলতবি বৈঠকই গত মঙ্গলবার থেকে আবার শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের গত মঙ্গলবারের আলোচনায় অংশ না নিলেও গতকালের আলোচনায় অংশ নেয় জামায়াত।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর গতকালের আলোচনার বিরতিতে জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। আলোচনা শেষেও অনেক দলের নেতা গণমাধ্যমে কথা বলেছেন।
এনসিসির পক্ষে জামায়াত-এনসিপি: বৈঠকের বিরতিতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জামায়াত এনসিসি গঠনের পক্ষে। এর মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। তবে এনসিসির গঠন ও আওতা নিয়ে ভিন্নমতের কথা জানান জামায়াতের এই নেতা।
তিনি বলেন, এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে না রাখার পক্ষে মত দিয়েছে তাঁর দল। তিন বাহিনী প্রধানের নিয়োগও এই কমিটির আওতায় না রাখার পক্ষে জামায়াত।
তবে বিষয়টি আরও আলোচনার দাবি রাখে বলে মন্তব্য করেন সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। এনসিসি গঠনের পক্ষে অবস্থান জানিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, যাঁরা এনসিসি গঠনের বিপক্ষে, তাঁরা মূলত ফ্যাসিবাদী কাঠামোয় থেকে যেতে চান।
আলোচনার বিরতিতে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর দল এনসিসি গঠনের প্রস্তাবকে সমর্থন জানায়। তবে গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁদের দ্বিমত রয়েছে উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, এখানে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান নিয়োগের ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। পাশাপাশি এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে রাখা উচিত নয়। এটা নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে।
বাংলাদেশের অতীত বিবেচনায় দেশকে ভবিতব্য স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করতে এনসিসি জরুরি বলে মন্তব্য করেন ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান। তবে তাঁর দল এনসিসির কাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্রপতির অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ভিন্নমত দিয়েছে।
আলোচনা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এনসিসি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও প্রধান নিয়োগে রাষ্ট্রপতির কাছেই প্রস্তাব দেবে। এর ফলে রাষ্ট্রপতি নিজেই এনসিসির অংশ হলে সেটা বেমানান হয়। রাষ্ট্রপতিকে এনসিসির বাইরে এই কারণেও রাখা দরকার, যেন এনসিসির কোনো বিষয়ে সমস্যা হলে অন্তত রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়া যায়।
তবে প্রধান বিচারপতি অথবা বিচার বিভাগ থেকে একজনকে এনসিসির সদস্য করার ব্যাপারে ইসলামী আন্দোলন মতামত দিয়েছে। যাঁরা দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে অনাগ্রহী, তাঁরাই কেবল এনসিসি নিয়ে দ্বিমত করতে পারে বলে মন্তব্য করেন গাজী আতাউর রহমান।
তিনি আরও বলেন, ইসলামী আন্দোলন এনসিসির কার্যপরিধির মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান নিয়োগের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে। এটা নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকতে পারে। তবে বিচার বিভাগ যেহেতু স্বাধীন, তাই প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টিও এনসিসির কার্যপরিধির মধ্যে থাকার বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন মত দিয়েছে।
আলোচনা শেষে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, এবি পার্টি এনসিসি গঠন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেকট্রোরাল কলেজ পদ্ধতিতে সম্মত। এছাড়া গণসংহতি আন্দোলন ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল এনসিসি গঠনের পক্ষে মত দিয়েছে।
বিপক্ষে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল: বিএনপি শুরু থেকেই এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করে আসছে। দলটি মনে করে, এনসিসি গঠিত হলে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব খর্ব হবে। গতকালের আলোচনা শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, জবাবদিহি নেই, এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি সমর্থন জানাতে পারে না।
সালাউদ্দিন আহমদ বলেন, এনসিসিকে সাংবিধানিকভাবে অনেক অনেক ক্ষমতা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের জবাবদিহি নেই। যদি অথরিটি থাকে, পাওয়ার ফাংশন থাকে, কিন্তু অ্যাকাউন্টেবিলিটি না থাকে, সেই রকম কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমরা গণতান্ত্রিক দল হিসেবে সমর্থন জানাতে পারি না।
এই ফাংশনগুলো আলাদা করে আরেকটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করার মধ্য দিয়ে একটা ইনব্যালেন্স (ভারসাম্যহীনতা) সৃষ্ট করা হবে। এনসিসির বিষয়ে বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, রাষ্ট্রপতিকে প্রধান করে নয় সদস্যবিশিষ্ট একটি সাংবিধানিক কাউন্সিলের প্রস্তাব করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
সেখানে প্রধানমন্ত্রী, উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেত্রী, প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল কর্তৃক ডেপুটি স্পিকারকে নিয়ে এসসিসি গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতির কাছে এই এনসিসির প্রস্তাব করবেন। আমরা এ ধারণার সঙ্গে একমত নই। একটি ভারসাম্যমূলক রাষ্ট্রকাঠামো, সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কী করতে পারি, সেটা আমাদের চিন্তা করা উচিত।
আলোচনার বিরতিতে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ১২দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমরা এনসিসি গঠনের বিপক্ষে। এই মুহূর্তে এনসিসি গঠনের জন্য সময়ক্ষেপণ করা অপ্রয়োজনীয়।
আলোচনার বিরতিতে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সও। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য যেসব কাজ করা দরকার, সরকারকে সেসব বিষয় সম্পন্ন করার জন্য আমরা বলেছি। এনসিসি গঠনের বিষয়ে আমরা ইতিবাচক মত দিলেও বিষয়টি নির্বাচিত সংসদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
এই মুহূর্তে সিপিবি এনসিসি গঠনের প্রয়োজন মনে করছে না উল্লেখ করে রুহিন হোসেন বলেন, এটা করা হলে সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার মনে হবে। তবে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় আগামীতে আমরা এটাকে ভাবনায় রাখব। এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন। সেটাকে প্রাধান্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হওয়া দরকার।