ঢাকা | জুন ১৬, ২০২৫ - ৩:১৬ অপরাহ্ন

হরমোনের মাসুল দিচ্ছেন আম চাষিরা

  • আপডেট: Sunday, June 15, 2025 - 11:54 pm

মোজাম্মেল হক, চারঘাট থেকে: সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসের গল্পের মত অধিক লোভে হরমোন প্রয়োগ করে প্রকৃতিকে দোহন করে এখন মাসুল দিচ্ছেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার আমচাষিরা। অতিরিক্ত ফলনের লোভে আমগাছে মাত্রাতিরিক্ত কালটার (হরমোন) ব্যবহারের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে এ অঞ্চলের আম উৎপাদন।

এবার গত কয়েক বছরের মধ্যে সবোর্চ্চ পরিমাণ মুকুল আসলেও অধিকাংশ বাগানেই আম নেই। এতে আমের বাগান কেটে অন্য ফসল উৎপাদনে ঝুঁকছে চাষিরা। আম চাষিরা বলছেন, সাধারণত আম বাগানে এক বছর ভালো মুকুল এলে পরের বছর কম আসে। কিন্তু আম ব্যবসায়ীরা দুই-তিন বছরের চুক্তিতে চাষিদের বাগান কিনে নেয়।

তারা লাভের আশায় প্রতিবছর গাছে আম নিয়ে আসতে হরমোন প্রয়োগ করে। ২০১০ সালের পর থেকে রাজশাহী সীমান্তবর্তী উপজেলা চারঘাট ও বাঘায় নিষিদ্ধ কালটার হরমোনের প্রয়োগ শুরু হয়। আগে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে অবৈধ পথে খুব সহজেই নিষিদ্ধ কালটার ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছে যেত। কিন্তু হরমোন ব্যবহার বৈধ হবার পর কিছু আম চাষি ও অধিকাংশ আম ব্যবসায়ী মাত্রাতিরিক্ত হারে হরমোন প্রয়োগ শুরু করেছে।

ফল গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, আম গাছে মাত্রাতিরিক্ত হরমোন প্রয়োগ রোধে ও তা একটি নীতিমালার মধ্যে নিয়ে আসতে ২০২০ সালের মার্চ মাসে সরকার আম চাষের জন্য হরমোন ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। এর মূল নাম ‘প্যাকলোবুট্রাজল’। বাংলাদেশে ‘কালটার’ নামে এর বাজারজাতকরণ করা হয়েছে।

তবে হরমোন ব্যবহারের নির্ধারিত মাত্রা রয়েছে। মাত্রা অনুযায়ী প্রতি বর্গমিটারে গাছের গোড়া থেকে এক ফুট দূরে রিং করে চার মিলিলিটার ওষুধ পাঁচ লিটার পানিতে মিশিয়ে দিতে হবে। দেয়ার আধা ঘণ্টা পর সেচ দিতে হবে। পর্যাপ্ত খাবার দিতে হবে, না হলে দুই-তিন বছর পর গাছটি মারা যেতে পারে। আট-নয় বছরের ছোট গাছে ও বেশি বয়সী গাছে হরমোন ব্যবহার করা যাবে না।

কিন্তু নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কথা বলে হরমোন ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হলেও বেশি আম ফলাতে গিয়ে মাত্রাতিরক্ত প্রয়োগ করে গাছই মেরে ফেলছেন ব্যবসায়ীরা। গাছের গোড়া থেকে এক ফুট দূরে রিং করে প্রয়োগের কথা বললেও কেউ গাছের বাকল কেটে আবার কোউ শেকড় কেটে ইচ্ছেমত প্রয়োগ করছেন। এতে গাছে প্রচুর মুকুল ও গুটি আসলেও গাছে পর্যাপ্ত শক্তি না থাকায় শেষ পর্যন্ত আম ধরে রাখতে পারছে না। লাগাতার ব্যবহার ফলে মারা যাচ্ছে গাছ।

এ অবস্থায় গাছ লিজ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাগান মালিকরা থানাসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। চারঘাট উপজেলার রাওথা এলাকার আম চাষি শফিকুল ইসলাম বলেন, বিপদে পড়ে তিন বিঘা বাগান দু বছরের জন্য লিজ দিয়েছিলাম। ব্যবসায়ীর সাথে শর্ত ছিল হরমোন ব্যবহার করা যাবে না।

এরপরও রাতে অন্ধকারে হরমোন প্রয়োগ করেছে। পর পর দু বছর পর এ বছরও প্রচুর মুকুল এসেছিল কিন্তু আম তো টেকেইনি উল্টো ১৩টি গাছ মারা গেছে। এ বিষয়ে গ্রাম্য আদালতে অভিযোগ দায়ের করার পর একটা মিমাংসা হয়েছে। কিন্তু গাছগুলো সব শেষ।

বাঘা উপজেলার মীরগঞ্জ এলাকার আম চাষি শরিফুল ইসলাম বলেন, এ বছরে যে পরিমাণ মুকুল এসেছিল গত পাঁচ বছরেও আসেনি। কারণ লোভে পড়ে হরমোন দিয়েছিলাম। ৩২ টি গাছে মুকুল আসার পরেও আম টেকাতে না পারায় মাত্র ১৭ হাজার টাকায় আম বিক্রি করেছি। অথচ গত বছর হরমোন ছাড়া মুকুল কম আসলেও ৬২ হাজার টাকার আম বিক্রি করেছিলাম। হরমোনের কারণে সব বাগানে একই অবস্থা।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীর নয় উপজেলায় ১৯ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬০ হাজার ছয় টন। জেলার চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় রয়েছে ১২ হাজার ২১৮ হেক্টর (দুই তৃতীয়াংশ)। গত দুই বছরে চারঘাটে ৬০ ও বাঘায় ৮০ হেক্টরসহ ১৪০ হেক্টর জমির আমবাগান কেটে ফেলেছেন চাষিরা। হরমোন প্রয়োগের ফলে গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বাগান কাটার মূল কারণ বলছেন বাগানিরা। এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অসম্ভব হবে বলছেন চাষিরা।

চারঘাটের ভায়ালক্ষীপুর এলাকার আম চাষি আবু সিনা বলেন, আমের এমন দূরবস্থা গত এক যুগেও দেখিনি। হরমোন প্রয়োগের ফলে কয়েক বছর প্রচুর আম এসেছিল। এ বছর প্রচুর মুকুল ও গুটি আসলেও এখন গাছে পাতা পর্যন্ত নেই। অধিকাংশ গাছ মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে গত সপ্তাহে পাঁচ বিঘা আমের বাগান কেটে ফেলেছি।

অন্য ফসল আবাদ করবো আর কখনও আম চাষ করবোনা। বাঘা উপজেলার আড়পাড়া এলাকার আম ব্যবসায়ী কামাল হোসেন বলেন, ১১ লাখ টাকায় ৯ বিঘা বাগান দু বছরের জন্য লিজ নিয়েছি। প্রতিযোগিতার বাজারে দুই-তিন বছরের জন্য বাগান লিজ নিয়ে আসল টাকা তোলাই কঠিন হয়ে পড়ে।

এছাড়াও আমের সাইজ ও রং ভাল চায় ক্রেতারা। এজন্য একটু হরমোন প্রয়োগ না করলে হয় না। গ্রামের মোড়ের দোকানগুলোতেও এখন হরমোন বিক্রি করে এজন্য চাষি ও ব্যবসায়ী সকলেই ব্যবহার করছে। চারঘাটের বাঁকড়া বাজারের আমের আড়তদার আলতাফ হোসেন বলেন, মৌসুমে শুরু মুকুল ও গুটি দেখে সবাই ভেবেছিল এ বছর বাম্পার ফলন হবে।

বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বাগানও কিনেছিল। কিন্তু এখন অধিকাংশ গাছে আম নেই। ব্যবসায়ীরা লোকসানে কেউ আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। হরমোন বাজারে আসার পর থেকে আমের গতি প্রকৃতি সব পরিবর্তন হয়ে গেছে।

চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন হাসান বলেন, গাছের ফল প্রদানের সক্ষমতার বাইরে গিয়ে ছোট ও বেশি বয়সী গাছে খেয়াল খুশিমত ভাবে হরমোন প্রয়োগ করছেন কেউ কেউ। গাছের বাকল ও শেকড় কেটেও প্রয়োগ করা হচ্ছে। যে হারে হরমোন প্রয়োগ হচ্ছে সে হারে খাবার পাচ্ছেনা গাছগুলো।

নির্দেশনা না মানায় কয়েক বছরের মধ্যে গাছ মারা যাচ্ছে। ফল গবেষণা কেন্দ্র রাজশাহীর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.শফিকুল ইসলাম বলেন, এ বছর ৯০ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছিল কিন্তু সে পরিমাণ আম গাছে নেই। সাধারণত গাছে মুকুল ও ফল আনার জন্যই এ হরমোন প্রয়োগ হয়।

যেসব চাষি যারা হরমোন প্রয়োগ করছেন তাঁদের কারোরই এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই। যেকোনো দোকান থেকে কিনে নিজেদের খেয়ালখুশি মত প্রয়োগ করে গাছের ক্ষতি করছেন। আম গাছে হরমোন প্রয়োগের আগে এর ক্ষতিকর দিক ও সঠিক নিয়ম জেনে হরমোন প্রয়োগ করা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।

Hi-performance fast WordPress hosting by FireVPS