ঢাকা | জুন ১৩, ২০২৫ - ১০:০৬ অপরাহ্ন

মধ্যপাড়া খনি ইয়ার্ড:পাথরের মজুদ আছে, বিক্রি নেই

  • আপডেট: Thursday, June 12, 2025 - 11:20 pm

এম জলিল সরকার, পার্বতীপুর থেকে: দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া খনি ইয়ার্ডে সাড়ে ১১ লাখ মে. টনেরও বেশি পাথরের বিশাল মজুদ গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ব্লাস্ট পাথর (রেলপথে ব্যবহৃত) ও বোল্ডার (নদী শাসন কাজে ব্যবহৃত) রয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ  মে.টন। ব্লাস্ট ও বোল্ডারের অন্যতম ক্রেতা যথাক্রমে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও পানি উন্নয়ন বোর্ড।

কিন্তু ওই দুই সরকারি প্রতিষ্ঠানে মধ্যপাড়ার পাথর ব্যবহার নেই বললেই চলে। দ্রুত এসব পাথর বিক্রির গতি বাড়াতে না পারলে স্থানাভাবে কিছুদিনের মধ্যে খনির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খনি বন্ধ হয়ে গেলে উৎপাদন ঠিকাদারের অধীনে কর্মরত প্রায় শত শত খনি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবার পরিজন

জানা গেছে, দেশের একমাত্র-ভূগর্ভস্থ মধ্যপাড়া পাথর খনি থেকে বছরে বিভিন্ন সাইজের প্রায় ১৫ লাখ মে.টন পাথর উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে ৫-২০মিলি সাইজ ১৮ শতাংশ, ২০-৪০মিলি সাইজ ৫ শতাংশ, ৪০-৬০মিলি (ব্ল্াস্ট) সাইজ ৩৪ শতাংশ, ৬০-৮০মিলি সাইজ ১১ শতাংশ, বোল্ডার সাইজ ১৭ শতাংশ ও ০-৫মিলি (স্টোন ডাস্ট) সাইজ ১৫ শতাংশ। সুত্রমতে, অধিকাংশ নির্মাণ কাজে থ্রি ফোর (৮-১২মিলি) সাইজের পাথর ব্যবহৃত হয়।

কিন্তু মধ্যপাড়ায় ওই সাইজের পাথর উৎপাদন হয় না। তবে ৫-২০মিলি সাউজ থ্রি ফোর হিসেবে ব্যবহার হয়। এই সাইজের পাথরের চাহিদা প্রচুর। কিন্তু উৎপাদন হয় মাত্র ১৮ শতাংশ। অথচ মোট উৎপাদনের ৫১ শতাংশ ব্লাস্ট ও বোল্ডার। এই দুই সাইজের পাথরের বিক্রি  নেই।

জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়ে বিগত সরকারের সময়ে কয়েকটি মেগা প্রকল্পে নতুন  রেলপথ নির্মাণে ভারত থেকে আমদানিকৃত পাথরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর ফলে গত তিন বছর ধরে রেলপথে মধ্যপাড়ার ব্লাস্ট পাথরের ব্যবহার কমে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ মজুদ গড়ে উঠেছে।

সম্প্রতি রেলের পশ্চিমাঞ্চলের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের আলোকে বাকীতে পাথর সরবরাহ শুরু হলেও তা আশানুরূপ নয় বলে খনি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। নদী শাসন কাজে খনির বোল্ডার প্রচলিত ব্লক-এর (খোয়া-বালু-সিমেন্টের মিশ্রণ) তুলনায় অনেক বেশি টেকসই, উন্নতমানের ও আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী হওয়া সত্বেও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড মধ্যপাড়া বোল্ডার ব্যবহার করে না।

এখানকার স্টোন ডাস্ট সড়ক নির্মাণে সিলকোট কাজে ব্যবহার উপযোগী হিসেবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)-এর ল্যাবে উত্তীর্ণ। এরপরও এলজিইডি’র কাজে মধ্যপাড়ার স্টোন ডাস্ট ব্যবহার না করে আমদানিকৃত স্টোন ডাস্ট দিয়ে রাস্তার সিলকোট সম্পাদন করা হয়ে থাকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে খনির দায়িত্বশীল দুজন কর্মকর্তা জানান, দেশে প্রতিবছর পাথরের চাহিদা ২ কোটি ১৬ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি। যার সিংহভাগই আমদানি করা হয় ভারত ও ভুটান থেকে। আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন হওয়ার পরও নানা অযুহাতে পাথর ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যপাড়ার পাথর ব্যবহারে অনিহা রয়েছে।

পাথর আমদানির উপর শুল্ক বৃদ্ধি ও মধ্যপাড়ার পাথরের ট্যারিপ ভ্যালু বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সেতু বিভাগ, বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, এলজিইডি, গণপূর্ত বিভাগ, বাংলাদেশ রেলওয়ে ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদী শাসন কাজের প্রকল্পসমূহে মধ্যপাড়া পাথর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।

জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ খনিটি সফল ভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর তদারকি করাও প্রয়োজন। মধ্যপাড়ার পাথর ব্যবহার করা হলে এদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে, অপরদিকে দেশের একমাত্র ভূগর্ভস্থ পাথর খনিটিকেও বাঁচিয়ে রাখা যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী ডি.এম. জোবায়েদ হোসেন জানান- ৩১ মে পর্যন্ত খনি ইয়ার্ডে মজুদ পাথরের পরিমাণ ১১ লাখ ৫২ হাজার মে.টন।  এরমধ্যে রেলপথে ব্যবহৃত ৬ লাখ ৯০ হাজার টন ব্লাস্ট পাথর এবং নদী শাসনের কাজে ব্যবহৃত ৩ লাখ ৩৫ হাজার টন বোল্ডার রয়েছে।

এসব পাথরের বিক্রি নেই। ব্লাস্ট ও বোল্ডার বিক্রিতে গতি না আসলে স্থানাভাবে খুব শিগগির পাথর উৎপাদন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খনির মোট উৎপাদনের ৫১ শতাংশ ব্লাস্ট ও বোল্ডার পাথর। ব্লাস্ট ও বোল্ডারের অন্যতম ক্রেতা যথাক্রমে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। সরকারি এই দুই প্রতিষ্ঠান পাথর না নেয়ায় বিপুল পরিমাণ মজুদ গড়ে উঠেছে।

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ২৫ মে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে খনির উৎপাদন ও রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছে বেলারুশের জেএসসি ট্রেস্ট সকটোস্ট্রয় ও দেশিয় একমাত্র মাইনিং কাজে অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া করপোরেশন লিমিটেড নিয়ে গঠিত জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামকে (জিটিসি)।

বর্তমানে খনি ভূগর্ভে বিশ্বমানের অত্যাধুনিক মাইনিং ইক্যুইবমেন্ট বসিয়ে ইউরোপিয়ান দক্ষ প্রকৌশলীদল ও দক্ষ খনিশ্রমিক দিয়ে পাথর উত্তোলন কাজ চালানো হচ্ছে। পূর্ণমাত্রায় পাথর উৎপাদন করায় ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছর থেকে মুনাফা করে আসছে খনিটি। জিটিসির প্রথমদফা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর।

দ্বিতীয় দফা চুক্তির আওতায় ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে পাথর উৎপাদন করছে তারা। দ্বিতীয়দফা চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ৬ বছরে ৮৮ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন করে দিবে। জ্বালানি উপদেষ্টা, পেট্রোবাংলাসহ সংশ্লিষ বিভাগ গুরুত্বপূর্ণভাবে নজর দিলে মধ্যেপাড়া পাথর খনির দেশের সরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগকৃত ঠিকাদাররা পাথর ব্যবহার করলে খনি সচল থাকবে এবং শ্রমিকরাও বেঁচে থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

Hi-performance fast WordPress hosting by FireVPS