তানোরে হারিয়ে যাচ্ছে গরিরের এসি মাটির বাড়ি

সাইদ সাজু, তানোর থেকে: রাজশাহীর তানোরে নতুনভাবে তৈরি না হওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গরিবের এসি মাটির বাড়ি। পুরোনো মাটির বাড়িগুলো ভেঙে তৈরি করা হচ্ছে ইট সিমেন্টের পাকা বিল্ডিং বাড়ি।
ফলে, তানোর থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের নিদর্শন সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা শান্তির নীড় মাটির দ্বিতল বাড়ি। বেশিদিনের কথা নয়, প্রতিটি গ্রামে নজরে পড়তো মাটির ঘর।
যাকে গ্রামের মানুষ বলে গরিবের এসি ঘর। ঝড়, বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশাপাশি অত্যন্ত ঠাণ্ডায় বসবাস উপযোগী এ মাটির ঘর এখন আর কেউ তৈরি করছেন না।
গ্রামের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন এসেছে, ফলে গ্রামাঞ্চলের পাড়া মহল্লায় তৈরি হচ্ছে পাকা ১তলা, ২তলা, ৩ তলা থেকে ৪ পর্যন্ত আধুনিকায়নের শহনের আদলে বাড়ি।
দরিদ্র পরিবার গুলোও বিভিন্ন এনজিওর ঋণ ও পরিশ্রম করে এখন তৈরি করছেন ছোট্ট আকারে পাকা বাড়ি। তার ওপরে তুলছেন টিনের চালা। এক সময় তানোর উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এ মাটির ঘর চোখে পড়তো।
যেখানে লাল বা চিপটে মাটি সহজলভ্য সেখানে এ ঘরগুলো বেশি তৈরি করা হয়। কিন্তু কালের আর্বতে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে এই ঐতিহ্যবাহী মাটির এক তলা ও দ্বিতল বাড়ি।
এই বাড়ি শীত ও গরম মৌসুমে আরামদায়ক বলে গ্রামের গরিব ও দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি অনেক বিত্তবানও এই মাটির বাড়ি তৈরি করতেন।
তবে, এখন জায়গার স্বল্পতা ও ঘর নির্মাণের মাটির স্বল্পতাসহ নানা কারনে এখন আর তৈরি হয় না মাটির বাড়ি। ফলে, হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরি ঘর বাড়ি।
এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা বলছেন, গরমে মাটির বাড়িতে গরম কম এবং শীতে মাটির বাড়িতে শীত কম। তারা আরও বলছেন, অতি প্রাচীনকাল থেকেই মাটির বাড়ির প্রচলন ছিল।
গ্রামের মানুষের কাছে এই বাড়ি ঐতিহ্যের প্রতীক ছিল। এঁটেল বা আঠালো মাটি কাদায় পরিণত করে ২-৩ ফুট চওড়া করে দেয়াল বা ব্যাট তৈরি করা হয়।
বাড়ির পার্শ্বের জমি থেকে মাটি নিয়ে ১০-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড় বা টিনের ছাউনি দেয়া হয়। মাটির বাড়ি অনেক সময় দোতলা ও তিন তলা পর্যন্ত করা হতো।
গৃহিণীরা ঈদ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আল্পনা এঁকে ঘরের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করতেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বর্ষা মৌসুমে মাটির ঘরের ক্ষতি হয় বলে বর্তমান সময়ে দীর্ঘ স্থায়ীত্বের কারণে গ্রামের মানুষরা ইট-সিমেন্টের বাড়ি নির্মাণে আগ্রহী হচ্ছেন।
ভূমিকম্প বা বন্যা না হলে একটি মাটির বাড়ি শত বছরেরও বেশি স্থায়ী হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে কালের বির্বতনে ইট-বালির দালান কোঠা আর বড় বড় অট্টালিকার কাছে হার মানছে মাটির বাড়ি।
তানোর উপজেলার চুনিয়া পাড়া গ্রামের আশরাফুল ইসলাম রন্জু বলেন, আমার বাবা আমার এই মাটির দ্বিতল বাড়ি তৈরি করেছেন। গরম কালে বাড়ির বাইরে প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও মাটির বাড়ির ঘরে গরম কম।
বাইরে প্রচণ্ড শীত হলেও ঘরের মধ্যে শীত কম অনুভব হয়। তানোর সদর গ্রামের মুন্জুর রহমান বলেন, পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া মাটির বাড়িতেই রয়েছে। আমার অন্য ভাইয়েরা পাকা বাড়ি করে বসবাস করছেন।
তবে মাটির ঘরে বসবাস খুব আরাম দায়ক। তিনি বলেন, তাদের পূর্ব পুরুষরাও এই মাটির তৈরি বাড়িতেই জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাই এখনও তারা এই বাড়িগুলো ভাঙেন নি।
ছাঐড় গ্রামের আইয়ুব আলী মন্ডল বলেন, মাটির বাড়িতে বসবাস খুবই আরাম দায়ক। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামে এখন আর কেউ মাটির বাড়ি তৈরি করেন না। যারাই বাড়ি করছেন তারা পাকা বিল্ডিং বাড়ি তৈরি করছেন।
তিনি বলেন, যারা পাকা বাড়ি করে বসবাস করছেন প্রচণ্ড গরমে কষ্টের মধ্যে পড়ে এসি কেনার চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বলেন, পাকা বাড়ির চেয়ে মাটির বাড়িতে বসবাস আরাম দায়ক।
মাটির বাড়ি বসবাসের জন্য আরামদায়ক হলেও যুগের পরিবর্তন আর প্রযুক্তির কারুকার্যে অধিকাংশ মানুষ মাটির বাড়ি ভেঙে অধিক নিরাপত্তা ও স্বল্প জায়গায় দীর্ঘ স্থায়ীভাবে বেশি লোক বসবাসের জন্য গ্রামের মানুষরা ইটের বাড়িঘর তৈরি করছেন বলে অনেকের ধারণা। নতুন ভাবে তানোরে কেউ আর মাটির বাড়ি তৈরি করছেন না। ফলে, তানোর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরি ঘর বাড়ি।