রেলের আয় বাড়াতে গ্রহণ করা হচ্ছে নানা পরিকল্পনা

সোনালী ডেস্ক: ক্রমাগত লোকসান গুনছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বর্তমানে রেল ১ টাকা আয় করতে আড়াই টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে। আর বছরের পর বছর ধরে রেলওয়ে এ লোকসান দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে রেলের আয়-ব্যয়ের ফারাক কমাতে একগুচ্ছ কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।
ওসব কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদে রেলওয়েকে লাভজনক অবস্থায় আনা। রেলের ব্যয় কমাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় কমানো, লোকসানি রুটে ট্রেনের চলাচল কমিয়ে লাভজনক পথে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো।
তাছাড়া রেলের বিপুল ভূসম্পত্তি ইজারা (লিজ) দিয়েও আয় বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ রেলওয়ে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন এবং অন্যান্য খাত থেকে ৮৩৬ কোটি টাকা আয় করেছে। কিন্তু ওই সময় সংস্থাটি ২ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। সামপ্রতিক সময়ে রেলওয়ে প্রতিবছর গড়ে দুই হাজার কোটি বা তার বেশি লোকসান দিচ্ছে।
যদিও ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে রেলওয়ে একবারই লাভ করেছিল। ওই অর্থবছরে সংস্থাটি ১ টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় করেছিল ৯৫ দশমিক ৯ পয়সা। তারপর থেকে রেলের আয়-ব্যয়ের ফারাক বেড়েই চলেছে। আয়-ব্যয়ের অনুপাতের ক্ষেত্রে রেল দৈনন্দিন কাজে যে ব্যয় করে তাই বিবেচনায় নেয়া হয়। ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে বেতন-ভাতা, অবসরে যাওয়া কর্মীদের প্রাপ্য সুবিধা, জ্বালানি খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়।
আর রেলের আয়ের উৎস যাত্রী ও মালামাল পরিবহন। তার বাইরে রেলওয়ে নিজেদের ভূমি ইজারা দিয়েও কিছু আয় করে থাকে।
সূত্র জানায়, রেলের পরিচালন খাতে সামপ্রতিক বছরগুলোতে প্রতিবছর কমবেশি ১০ শতাংশ হারে ব্যয় বেড়েছে। ওই তুলনায় আয় বাড়ছে গড়ে ৫ শতাংশের কম। রেলওয়ে দীর্ঘদিন ধরে সিমেন্ট, সার, পাট, জ্বালানি ও খাদ্যপণ্য পরিবহনে উল্লেখযোগ্য আয় করে আসছিল।
কিন্তু ধীরে ধীরে রেলে ওসব পণ্যের পরিবহন কমে এলেও নেয়া হয়নি পণ্য পরিবহন বাড়ানোর বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ। বিগত সরকারের আমলে রেলের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। ওই টাকার বেশির ভাগই ছিল বিদেশি ঋণ।
তার মধ্যে পদ্মা সেতু সংযোগ রেলপথ (রেললিংক), চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণসহ বড় বড় প্রকল্পের ঋণের সুদসহ কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাছাড়া সামপ্রতিক সময়ে বিপুল টাকায় নতুন রেললাইন, ইঞ্জিন-কোচ কেনা হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রেলওয়ে পরিচালনা খাতে মোট ৩ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। তার মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরজনিত সুবিধা বা পেনশনের পেছনে ব্যয় হয়েছে ৯৪৬ কোটি টাকা। ওই ব্যয় কমানোর সুযোগ নেই।
তবে রেলওয়ে চাইছে ওই ব্যয় নিজস্ব বাজেট থেকে নয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট থেকে যেন পরিশোধ করা হয়। কারণ সরকারের অন্যান্য দপ্তরের এই সুবিধা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিশোধ করা হয়ে থাকে। তার বাইরে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা পরিহার এবং মেরামত খাতে ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।
তাছাড়া সংস্থাটি দেশ-বিদেশে ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনাও নিয়েছে। রেলসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে প্রাধিকারভুক্ত ব্যক্তি ছাড়াও নানাভাবে গাড়ি ব্যবহারের রীতি রয়েছে। প্রাধিকারের বাইরে গাড়ি ব্যবহার বন্ধ করে ব্যয় সংকোচনের চিন্তা আছে। তাতে জ্বালানি ও মেরামত খাতে ব্যয় কমবে এবং চালকের বেতন-ভাতা পরিশোধ কমে যাবে।
রেলে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় থাকা গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার এবং অস্থায়ী ভিত্তিতে চালক নিয়োগ দিয়ে তা পরিচালনা করা হয়। তাছাড়া রেলের ভবন, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে ব্যয় সাশ্রয়, রেলের বিভিন্ন কাজ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী শ্রমিক ও কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকৃত প্রয়োজন যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এদিকে রেলওয়ের স্বল্প মেয়াদে আয় বৃদ্ধির জন্য মালামালের পরিবহন বাড়াতে মিটারগেজ ও ব্রডগেজের জন্য ২৬টি ইঞ্জিন ও চালক যুক্ত করা, আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর চলাচলের পথ মূল্যায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথে যাত্রীদের বিপুল চাহিদা রয়েছে।
ওই রেলপথে চাইলে আরো কিছু আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা যায়। কম আয়ের লোকজনের জন্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন নেই। কিছু মেইল ট্রেন চালু করা গেলে মানুষের উপকারের পাশাপাশি রেলের আয়ও বাড়বে। বর্তমানে অধিকাংশ আন্তঃনগর ট্রেন ১০ থেকে ১৪টি কোচ দিয়ে পরিচালনা করা হয়।
ফলে ইঞ্জিন ও লোকবলের সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সেজন্য প্রতিটি আন্তনগর ট্রেনে ১৮ থেকে ২০টি বগি নিয়ে চলাচল নিশ্চিত করার কথা ভাবা হচ্ছে। তাতে জ্বালানি খরচ না বাড়িয়ে আয় বাড়ানো সম্ভব। তাছাড়া রেলওয়ের অপটিক্যাল ফাইবারের কিছু কিছু অংশ অব্যবহৃত আছে। সেগুলো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়ারও পরিকল্পনা করা হয়েছে।
তাছাড়া সারা দেশে রেলওয়ের মোট প্রায় ৬২ হাজার একর জমি আছে। তার মধ্যে কাগজে-কলমে ৫৮ হাজার ৬০৬ একর দখলে আছে। প্রায় ৩ হাজার ৬১৪ একর জমি বেদখল রয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে বেহাত হওয়া জমির পরিমাণ আরো অনেক বেশি।
অন্যদিকে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খাদ্যশস্য, সার, জ্বালানিসহ বিভিন্ন সরকারি মালামাল রেলের মাধ্যমে পরিবহন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে রেলওয়ে। এমনকি ট্রেনের ভেতরে, স্টেশনে ও রেলের জমিতে বিজ্ঞাপন প্রচারের ব্যবস্থা করে আয় বাড়ানোরও লক্ষ্য রয়েছে।
আগে রেলের ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ জরিমানা আদায় করতো। এ ক্ষমতা এখন রেলের কর্মকর্তাদের নেই। তা পুনরায় চালু করার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত চায় রেলওয়ে। যমুনা রেলসেতু চালু হওয়ার ফলে উত্তরবঙ্গ থেকে রেলপথে মালামাল পরিবহনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এর জন্য ঢাকার কাছাকাছি তেজগাঁও ও টঙ্গী রেলস্টেশনে মালামাল ওঠানো-নামানোর জন্য জায়গা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে। তাছাড়া রেল পরিচালনায় সরাসরি যুক্ত নয় এমন জমিতে বহুতল বিপণিবিতান, আবাসিক হোটেল ও অফিস ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দেয়া এবং বেশি সংখ্যায় ট্রেন পরিচালনার লক্ষ্যে ৮০টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
পাশাপাশি ৫০০টি ব্রডগেজ ও মিটারগেজ কোচ এবং দুই শতাধিক মালামাল পরিবহনের কনটেইনার সংগ্রহ করা হবে। ভবিষ্যতে ঢাকার আশপাশে কমিউটার ট্রেন বাড়াতে এর ২৫০টি কোচ সংগ্রহের কথাও বলা হয়েছে। আর দীর্ঘ মেয়াদে আরো কিছু রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের কথা বলছে রেলওয়ে।
তার মধ্যে ঢাকা থেকে কুমিল্লার লাকসাম হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নতুন লাইন নির্মাণ করা। তাতে রেলপথে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার কমে যাবে। আর চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট থেকে কুমিল্লার লাকসাম পর্যন্ত শুধু মালামাল পরিবহনের জন্য লাইন নির্মাণ করা।
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, রেলের ব্যয় কমাতেই হবে। কীভাবে অপচয় কমানো হবে এবং আয় বাড়ানো যায়, সেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে রেল কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। দ্রুতই কিছু উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত আসবে।