ঢাকা | জুন ৩, ২০২৫ - ২:০৩ অপরাহ্ন

উদ্বেগ ছড়াচ্ছে আফ্রিকান মাগুর

  • আপডেট: Monday, June 2, 2025 - 12:25 am

চারঘাট প্রতিনিধি: রাজশাহীর চারঘাট ও পুঠিয়া উপজেলা সংলগ্ন জয়পুর বাজারে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক মাছ ব্যবসায়ীকে ঘিরে অনেক ভিড়। সেখানে যেতেই মাছ ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম জানালেন বড় সাইজের দেশি মাগুর মাছ মাত্র ২২০ টাকা কেজি। কম দাম পেয়ে ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে কিনছেন।

বিক্রেতা জানালেন, নাটোরের বিল এলাকা থেকে কম দামে কিনে এনে সামান্য লাভে বিক্রি করছেন। ১০০% দেশি মাছের নিশ্চয়তা দিলেন তিনি। তবে মৎস্য অফিসের লোকজনকে ডাকার কথা বলতেই তিনি পাশে ডেকে নিয়ে হাত ধরে অনুরোধ করে জানালেন তার যেন ক্ষতি না করা হয়।

মূলত আফ্রিকান মাগুরগুলো তিনি পুঠিয়ার বানেশ্বর এলাকার মুরাদ আলী নামের একজন মাছ চাষির কাছে থেকে কিনেছেন। সম্প্রতি পার্শবর্তী গোবিন্দপুর বাজারে দেশি মাগুরের পরিচয়ে আফ্রিকান মাগুর বিক্রির সময় হাতে নাতে আটক করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরিফ হোসেন ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান। এ সময় ৮০ কেজি আফ্রিকান মাগুর মাছ জব্দ ও বিক্রেতা তবিবার রহমানকে চার হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এভাবে একের পর এক অভিযান চললেও রাজশাহীর চারঘাট, বাঘা ও পুঠিয়ার উপজেলা বাজারগুলোতে অনেকটা প্রকাশ্যেই দেশি মাগুর মাছের নামে আফ্রিকান মাগুর বিক্রি চলছে। সংঘবদ্ধ একটি চক্র যশোর জেলা থেকে এই মাছের পোনা সংগ্রহ করে উপজেলা পর্যারের প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলেও এ মাছের পোনা সরবরাহ করছে।

বিভিন্ন পুকুর ও বাড়ির আনাচে কানাচে রাক্ষসে এই মাছ করে বাজারগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে। বাজারে অন্য মাছের তুলনায় দামে কিছুটা কম হওয়ায় মধ্যবিত্ত, নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে এ মাছের চাহিদাও রয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের জুন থেকে আফ্রিকান মাগুরের আমদানি, উৎপাদন, বিপণনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এছাড়া বিদেশ থেকে আফ্রিকান মাগুর মাছ, মাছের রেণু ও পোনা আমদানি করলে জেল জরিমানার বিধান রেখে মৎস্য সংঘ নিরোধ আইন-২০১৭ এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ। কারণ সর্বভুক হওয়ায় আফ্রিকান মাগুরের জন্য দেশিয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

সম্প্রতি সরেজমিনে বাঘা উপজেলার মীরগঞ্জ হাটে গিয়ে আফ্রিকান মাগুর মাছ বিক্রি করতে দেখা গেছে। একই অবস্থা দেখা গেছে পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর হাটেও। ছোট সাইজের আফ্রিকান মাগুর দেদারসে দেশি মাগুর বলে বিক্রি করছেন মাছ ব্যবসায়ীরা। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, আফ্রিকার মাগুর মাছ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামান্য জায়গায় গর্ত করে নোংরা পানিতে চাষ করা হয়। এজন্য এর গায়ে কালো কালো ছোপ থাকে। যেটা দেশি মাগুরে নেই।

অথচ বিক্রেতারা বিলের মাছ এজন্য কালো ছোপ বলে দেশি মাগুর হিসেবে প্রমাণ করেন। আফ্রিকান মাগুরের মাথা দেশি মাগুরের মতো সূচালো হয় না। আফ্রিকার মাগুরের মাথা ও পেট বড় ও চোয়াল বিস্তৃত থাকে। দেশি মাগুর মাছের এমনটা থাকে না। কিন্তু ছোট সাইজের আফ্রিকান মাগুরের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের পক্ষে এগুলো চেনা কঠিন হয়ে পড়েছে।

চারঘাটের মাছ ব্যবসায়ী মহসিন আলী বলেন, আফ্রিকান মাগুর নিষিদ্ধ এটা অনেক ব্যবসায়ীই জানে না। কারণ স্থানীয় পর্যায়ে অনেকেই বাড়ির পাশে নলকূপের পানি নামাতে গর্তের মত ছোট জলাশয় তৈরি করে, ব্রিজের নীচে পানি আটকে কিংবা ইট-সিমেন্ট দিয়ে বদ্ধ জলাশয় তাতে এসব মাগুর চাষ করছেন। এসব মাগুর ১০-১৫ কেজি পর্যন্ত হয়।

কিন্তু বড়গুলো এসব বাজারে বিক্রি হয়না সেগুলো শহরের বিভিন্ন হোটেলে চলে যায়। শুধুমাত্র ১০০-১৫০ গ্রাম সাইজের গুলো তারা কিনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। অনেকেই দেশি মাগুর মনে করে তা ক্রয় করেন। চারঘাটের পাটিয়াকান্দি গ্রামের আজিবার রহমান পুকুরে দেশি মাছের পোনা ছেড়েছিলেন। ক’দিন আগে পানি সেচে দেখেন, ১০ ভাগের এক ভাগ মাছও নেই। তিনটি বিশাল সাইজের আফ্রিকান মাগুর পেয়েছেন। মৎস্য অফিসের কর্মকর্তা জানান, এ মাগুরই সব খেয়ে ফেলেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক মাছ চাষী জানান, আফ্রিকান মাগুরের রেনু পোনা উৎপাদন করা হয় যশোরের কাজীপুরে। ফোনে পোনার অর্ডার করলে প্লাস্টিকের ড্রামে করে পোনা সরবরাহ করায় হয়। প্রতিটি পোনার দাম চার থেকে ছয় টাকা। পরে ছোট জলাশয় ও বদ্ধ জায়গায় সেগুলো ছাড়া হয়। বাজারের বিভিন্ন মুরগির দোকানের সাথে এসব মাছ চাষীদের চুক্তি থাকে।

প্রতিদিন মুরগির নাড়িভুড়ি, পাখনা ও মাছের নাড়িভুড়ি সংগ্রহ করে এই মাছকে খেতে দেয়া হয়। তাতে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশি মাগুর মাছের সাইজে রূপ নেয়। অন্য মাছের তুলনায় খাবারের ঝামেলা কম থাকায় এ মাছে লাভ অনেক বেশি।

চারঘাট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, এই মাগুরগুলো ছোট বড় মাছ, মাছের ডিম, পোনা সেইসঙ্গে অন্যান্য জলজ প্রাণী মুহূর্তের মধ্যে খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলতে পারে। এই মাছ যদি কোনো ক্রমে নদী বা মুক্ত জলাশয়ে চলে যায় তাহলে মৎস্য সম্পদ ও পরিবেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

এজন্য নিষিদ্ধ এ মাছ ঠেকাতে বাজারগুলোতে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। চারঘাট উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, বাজারগুলো আফ্রিকান মাগুরের বিষয়ে প্রচারণার পাশাপাশি আইনগত কার্যক্রমও নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে একজনকে জরিমানা করা হয়েছে। ক্রেতাদেরও সচেতন হবার পরামর্শ দেন তিনি।

Hi-performance fast WordPress hosting by FireVPS