ব্যাংক খাতের সঙ্কট: একীভূতকরণই কি একমাত্র পথ?

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে এক নজিরবিহীন সঙ্কটে নিপতিত। একের পর এক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর্থিক দায় মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে, আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না।
মূলধন ঘাটতি, লাগামহীন ঋণখেলাপি, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে খাতটির ভিতই যেন নড়ে উঠেছে। এখন প্রশ্ন হলো-এই সঙ্কটের নিরসনে নেয়া উদ্যোগগুলো কি যথাযথ, নাকি সমস্যাকে আরও গভীর করে তুলছে? বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে কিছু দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
শরিয়াহভিত্তিক ছয়টি দুর্বল ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, একই সঙ্গে আর্থিক খাতে লোকসানগ্রস্ত ২০টি ব্যাংক-বহির্ভূত প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে একটি বা দুটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের চিন্তাভাবনা চলছে।
যদিও ‘বড় ব্যাংক’ গঠন একটি যৌক্তিক কৌশল হতে পারে, তবে একাধিক নেগেটিভ যোগ করে একটি পজেটিভ তৈরি করার ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। বরং এতে সুস্থ ব্যাংকগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
ব্যাংক একীভূতকরণ কোনো ম্যাজিক সমাধান নয়-বিশেষ করে যখন ফরেনসিক অডিট, সম্পদের প্রকৃত ভ্যালুয়েশন এবং ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ ছাড়াই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। ব্যাংকের মতো একটি সংবেদনশীল খাতে অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং স্বচ্ছতার অভাব থাকলে সঙ্কট আরও গভীর হতে বাধ্য। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ আরেকটি দিক তুলে ধরে।
গত নয় মাসে ব্যাংকগুলো শিল্পোদ্যোক্তাদের পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা না করায় বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। যারা নতুন উদ্যোগ নিতে চেয়েছেন, তারাও মূলধনের অভাবে থমকে দাঁড়িয়েছেন।
ব্যাংকিং খাতে যে বিপর্যয় চলছে, তা এখন আর কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ নেই-এটি সরাসরি দেশের উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সবচেয়ে আতঙ্কজনক দিক হলো, গ্রাহকদের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। গভর্নরের মন্তব্য-‘কয়েকটি ব্যাংক বাঁচানো সম্ভব নয়’-এই আস্থার সঙ্কটে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
ফলে কিছু ব্যাংকে হুড়োহুড়ি করে টাকা তোলার প্রবণতা দেখা দিয়েছে, যা যে কোনো সময় বড় ধরনের ব্যাংক-দৌড়ের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
এ অবস্থায় করণীয় কী? ‘অন্তরীণ সমাধান’ ও ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা’ ছাড়া এই খাত পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। জোরপূর্বক একীভূতকরণ না করে, প্রয়োজনে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে সময় দিয়ে ধীরে ধীরে পুনর্গঠন করতে হবে।
এছাড়াও খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। যারা নিয়মিত ঋণ শোধ করছেন, তাদের ক্ষতির মুখে ফেলা রাষ্ট্রীয় ন্যায়ের পরিপন্থী।
ব্যাংকগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে স্বাধীন নিয়ন্ত্রক কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এই খাত কেবল আর্থিক লেনদেনের নয়-এটি মানুষের বিশ্বাস, সঞ্চয় ও ভবিষ্যতের ভিত্তি।
এই ভিত্তিকে দুর্বল করা মানে দেশের অর্থনীতিকেই নড়বড়ে করে ফেলা। তাই সময় এসেছে, সঙ্কট নিরসনে কৌশলগত, স্বচ্ছ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়ার-না হলে আস্থার এই ধসের প্রভাব পড়বে গোটা অর্থনীতিতে।