মহাসড়কে বার বার ডাকাতি: এবারের ঈদ যাত্রা নিয়ে শঙ্কায় উত্তরের যাত্রীরা

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: ঢাকা-সিরাজগঞ্জ-রংপুর মহাসড়কে যাত্রীবাহী দু’টি বাস, চারটি মাইক্রো-প্রাইভেটকার ও দু’টি গরু-পণ্যবাহী ট্রাকসহ গত ছয় মাসে অন্তত সাতটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
বাসে ডাকাতি ও তল্লাশিকালে কয়েকজন নারী বাসযাত্রীকেও যৌন হয়রানি করা হয় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। যমুনা সেতুর পশ্চিম পাড়ে সম্প্রতি ডাকাতদলের লুটের গরুর ট্রাকের চাপায় গুরুতর আহত হয়ে কনস্টেবল রফিকুল ইসলাম প্রাণ হারান।
মহাসড়ক ছাড়াও সিরাজগঞ্জ জেলার অভ্যন্তরে চৌহালী, কামারখন্দ, কাজিপুর ও শাহজাদপুরে দশটি চুরি-ডাকাতির ঘটনাও রয়েছে। ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চল অভিমুখে ঈদপূর্ব যাতায়াতকারী মানুষজনের মধ্যে এবারও ডাকাতির শঙ্কা রয়েছে।
প্রতিটি ডাকাতির ঘটনার পর স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হলেও আসন্ন ঈদযাত্রায় আবারও ডাকাতি হয় কিনা, এমন আশঙ্কায় রয়েছেন কেউ কেউ। ঈদপূর্ব এক জিজ্ঞাসায় এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন কয়েকজন।
জানা যায়, যমুনার সেতুর পূর্ব পাড়ের ঢাকা-সিরাজগঞ্জ-রংপুর মহাসড়কের এলেঙ্গায় গত ২০ মে ঢাকা-রংপুরগামী ইমরান পরিবহণ নামের বাসে ডাকাতি হয়। ডাকাতির সময় তল্লাশির নামে কয়েকজন নারী যাত্রীর শ্লীলতাহানি ঘটে।
গত ২৪ এপ্রিল টাঙ্গাইলের এলেঙ্গার গরুবোঝাই ট্রাক লুটে নিয়ে সিরাজগঞ্জ হয়ে উত্তরাঞ্চল অভিমুখে যাবার চেষ্টা করে একদল ডাকাত।
পুলিশের ধাওয়া খেয়ে উল্টে টাঙ্গাইলের দিকে যেতে যমুনা সেতুর পশ্চিম পাড়ের সয়দাবাদ এলাকায় দায়িত্বরত সেতু পশ্চিম থানার পুলিশ সদস্য রফিকুল ইসলামকে চাকার নিচে পিষে মেরে পালিয়ে যায়।
রোজার ঈদের আগে যমুনা সেতুর পশ্চিম পাড়ের গোলচত্বর সাসেক প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আকতারের বেস ক্যাম্পে গত ১৩ মার্চ দুর্র্ধষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তা প্রহরীদের অস্ত্রের মুখে আটকে রেখে ব্যাটারিসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতি নিয়ে পালিয়ে যায় ডাকাতদল।
সদর থানায় মামলা হলেও অপরাধীরা ধরা পড়েনি। নিরাপত্তাপ্রহরীদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে ঘটনার পরদিন থানায় রাতভর আটকে নির্যাতন-হয়রানি করা হয়। পরে ২৭ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে নিরাপত্তা প্রহরীদের ছেড়ে দেয় পুলিশ।
নির্যাতিত ও ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আকতার লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী একলাছ উদ্দিন সমকালকে বিষয়টি পরবর্তীতে জানান।
গত ২২ মার্চ ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে রাজশাহীর কয়েকজন ব্যবসায়ীর গরু ও মহিষ বিক্রির ৭৮ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় সশস্ত্র অবস্থায় হোন্ডায় আসা একদল ছিনতাইকারী।
যমুনা সেতুর পশ্চিমপাড়ে গত ৭ ও ৯ মার্চ এবং ২২ ফেব্রুয়ারি ঝাঐল, কোনাবাড়ী ও কড্ডায় পৃথক তিনটি ঘটনায় মাইক্রোবাসে ডাকাতি হয়। জামায়াতপন্থি কয়েকজন শিক্ষক ঢাকা থেকে ফেরার পথে ডাকাতের কবলে পড়েন।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ঢাকা-নাটোরগামী রয়েলস্ পরিবহনে ডাকাতির সময় নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির শিকার হয়। যমুনা সেতুর পশ্চিম পাড়ে কড্ডার মোড়ে ৩০ ডিসেম্বর গরু বোঝাই আরেকটি ট্রাক ডাকাতির কবলে পড়ে।
ঠাকুরগাঁও থেকে গরুভর্তি একটি ট্রাক নারায়ণগঞ্জ যেতে কড্ডায় ডাকাতির কবলে পড়ে। ওই মহাসড়কের টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে গত ২০২২ সালের ২ আগস্ট ঢাকা-কুষ্টিয়াগামী পৃথক বাসে ডাকাতির সময় এক নারী যাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
এছাড়া, গত ২১ মে সিরাজগঞ্জের চৌহালীর যমুনার দুর্গম ঘোরজান ইউনিয়নের মুরাদপুর-কাউলিয়া একদল ডাকাতের হাতে নিজ গো-খামারে খুন হন তারা মিয়া। তিনটি গরু লুটে নিয়ে নাতি ইব্রাহিমকে বস্তাবন্দি করা হলেও প্রাণে বেঁচে যান।
গত ৩ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের চৌহালী এনায়েতপুরের দুর্গম চরাঞ্চলে কৃষক আলমগীর তার ও তার স্ত্রীর হাত-পা বেঁধে গোয়ালের প্রায় ২৮ লাখ টাকা মূল্যের ১১টি গরু লুট করে নিয়ে গেছে সংঘবদ্ধ ডাকাতদল। গত ২৪ মার্চ জেলার কাজীপুরের কুনকুনিয়া গ্রামে মাশফী ডেইরি ফার্মের ৪টি গরু লুটে নেয় ডাকাতদল।
এছাড়া, শাহজাদপুরের পোতাজিয়ায় ৩ ফেব্রুয়ারি ও সরিষাকোলে ৭ মার্চ দু’টি খামারে ৬টি গরু-ছাগল লুটের ঘটনা ঘটে। ঢাকার ব্যাংক কর্মকর্তার স্ত্রী রহমত আরা পারভীন শুক্রবার মুঠোফোনে জানান, প্রতিবছর সাধারণ ঈদের ছুটিতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে নীলফামারী শ্বশুড়বাড়ি রাতে নাইটকোচে যেতাম।
সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল জেলার ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে গত কয়েক মাসে কয়েকটি ডাকাতির খবর শুনে এবার আগে থেকেই দিনেরবেলার আগাম টিকেট কেটেছি। এলজিইডির প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত দিনাজপুর ঘোড়াঘাটের বাসিন্দা মিজনু বেগমও এমন আশঙ্কার কথা বলেন।
সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোখলেছুর রহমান বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠার মীর আকতারের বেস ক্যাম্পে গত ১৩ মার্চ ডাকাতির ঘটনাটি আমি যোগদানের আগে।
নতুন কোন চুরি-ডাকাতির ঘটনা যাতে না ঘটে, পুলিশ সুপারের নির্দেশে আমরা গত কয়েকদিন থেকেই দিনরাত কাজ করছি। সিরাজগঞ্জ ডিবি পুলিশের ওসি এবং ১৪টি ডাকাতি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. একরামুল হোসাইন শুক্রবার সকালে জানান জেলার অধিকাংশ ডাকাতি মামলা শনাক্ত করা হয়েছে।
অধিকাংশ আসামিরাই ধরা পড়েছে। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও চৌহালীর ঘটনার অভিযুক্তদের যমুনার দুর্গম চরাঞ্চলে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ।
সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বলেন, চৌহালীর ডাকাতির ঘটনার পর পুলিশ তৎপর হওয়ায় নতুন কোনো ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। আগামী ১ জুন থেকে জেলা পুলিশের ৫ শতাধিক সদস্য পালাক্রমে দিনরাত্রি ঈদের আগে জেলার ৮৮ কিলোমিটার মহাসড়ক বাদেও অভ্যন্তরের আঞ্চলিক সড়কে দায়িত্ব পালন করবেন।
হাইওয়ে পুলিশ সুপার অতিরিক্ত ডিআইজি মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ঢাকা-রংপুর ও ঢাকা-রাজশাহী ও বগুড়া-নগরাড়ি মহাসড়কের ৬৩টি পয়েন্টে আমাদের ছয় শতাধিক পুলিশ ঈদের নিরাপত্তায় থাকছেন।
হাইওয়ে ও জেলা পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-সেনাবাহিনী আগে থেকে তৎপর। ইনশাল্লাহ, এবার মহাসড়কে ডাকাতির আশঙ্কা নেই।
এদিকে, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে গত ১৭ ফেব্রুয়ারির ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে মানিকগঞ্জের শহিদুল ইসলাম মুহিত, শরীয়তপুরের জাজিরার সবুজ ও ঢাকার সাভারের শরীফুজ্জামান (২৮) এবং একই মহাসড়কে মির্জাপুরে গত ২০ মে পৃথক বাস ডাকাতির ঘটনায় সিরাজগঞ্জ জেলা সদরের রহিমপুরের সাব্বির হোসেন, সিহাব সরকার ও জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত ২৪ এপ্রিল যমুনা সেতুর পশ্চিম পাড়ে ট্রাক চাপার তিনদিন পর কনস্টেবল রফিকুল খুনের আসামি নুর ইসলামকে গত ২৭ মে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এছাড়া, গত ২২ মার্চ মির্জাপুরে রাজশাহীর গরু ও মহিষ ব্যবসায়ীর ৭৮ লাখ টাকা লুটের ঘটনায় হোন্ডা, পিস্তল ও ১০ রাউন্ড গুলি ও লুটের ৬ লাখ টাকাসহ তিনজন গ্রেপ্তার হন। যৌথ অভিযানে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে গ্রেপ্তার হন মাইক্রোবাসচালক মিলন, যাত্রাবাড়ী থেকে ইসমাইল হোসেন মামুন ও শুটার সাগর বারুই খিলগাঁও থেকে।
টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আদনান বলেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈরের চন্দ্রাতে ছদ্মবেশে ছিনতাইকারীরা প্রাইভেটকারে যাত্রী উঠিয়ে তাদের জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেওবার বিষয় জেনে চক্রকে ধরতে চেষ্টা চলছে।
এছাড়া, গত ২২ মার্চ মির্জাপুরে রাজশাহীর গরু ও মহিষ ব্যবসায়ীর ৭৮ লাখ টাকা লুটের ঘটনায় প্রাইভেটকারসহ একটি পিস্তল ও ১০ রাউন্ড গুলি এবং লুটের ৬ লাখ টাকাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।