ঢাকা | মে ২৯, ২০২৫ - ৯:৪৭ অপরাহ্ন

বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ধান, দিশেহারা বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক

  • আপডেট: Wednesday, May 28, 2025 - 12:06 am

স্টাফ রিপোর্টার: গত এক সপ্তাহ ধরে বরেন্দ্র অঞ্চলে টানা বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টিতে রাজশাহী, চাঁপাই, বগুড়া, নাটোর ও নওগাঁ অঞ্চলের বিভিন্ন নিচু বিল ও জমির পাকা ধান তলিয়ে গেছে। সোনার ফসল বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চোখে-মুখে হতাশা আর চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এসব অঞ্চলের কৃষকরা। একটানা বৃষ্টির কারণে ধান কেটে ঘরে তুলতে পারেননি কৃষকরা। এতে জমিতেই পচে নষ্ট হচ্ছে এসব ধান। অনেক এলাকায় ধান কাটার জন্য মিলছে না শ্রমিকও।

রাজশাহী, চাঁপাই, বগুড়া, নাটোর ও নওগাঁ অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ এলাকায় বৃষ্টিতে মাঠে পাকা ধান মাটিতে নুইয়ে পড়েছে। অনেক জমিতে কেটে রাখা ধান পানিতে ডুবে গেছে। এতে ধানের সঙ্গে ডুবছে কৃষকের স্বপ্নও। কেউ হাঁটু পানিতে নেমে ধান কাটছেন।

আবার কেউ কাটা ধান উঁচু স্থানে তুলছেন। আবার কেউ কাটা ধানগুলো পানিতে ভাসমান অবস্থায় ছড়িয়ে থাকা একত্র করছেন। বৃষ্টির মধ্যে অনেক কৃষক পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছেন। এখন ধান কাটার মৌসুম শেষের দিকে। তারপরও অনেক কৃষক খেতের ধান ঘরে তুলতে পারেননি। আর দুই-এক সপ্তাহ সময় পেলে ধান কাটা মাড়াই করে ঘরে তুলতে পারতেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, একদিকে শ্রমিক সঙ্কট, অন্যদিকে বৈরী আবহাওয়া।

দুয়ে মিলে যেন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেতে কেটে রাখা ধানও বৃষ্টির পানিতে ভাসছে। অন্যদিকে, কাটা ধান মাড়াইয়ের পর ভেজা ধান শুকানো নিয়েও রয়েছে দুশ্চিন্তা। বৃষ্টির কারণে বাড়ির উঠানেও কাঁদা হয়ে আছে। সড়কেও ধান শুকাতে পারছেন না তারা।

চাঁপাই অঞ্চলের এক কৃষক আলী হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, নয় বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলাম। এরমধ্যে দুই বিঘা জমির ধান কেটে ঘরে তুলতে পেরেছি। বাকি সাত বিঘা জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এ অবস্থায় ধান কাটা যাচ্ছে না। ধানের জমিতে এখন হাঁটু-কোমর সমান পানি। আনারুল ইসলাম নামের আরেক কৃষক বলেন, দুই বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু বৃষ্টির পানিতে সব তলিয়ে গেছে।

এতে জমিতেই ধানের বীজ গজাতে শুরু করেছে। বৃষ্টির পানিতে তিন বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়েছে কৃষক মোস্তাফিজুর রহমানের। তিনি সংবাদিকদের বলেন, এসব ধানে বীজ গজাতে শুরু করেছে, তাই বাজারে বিক্রি হবে না। কারণ এসব ধানের চালে গন্ধ হতে পারে। এসব ধানের বীজও হবে না। তাই ফেলে দেয়া ছাড়া উপায় নেই। এতে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।

নাটোরের সিংড়া উপজেলার চলনবিলের কৃষক তুহিন আলী সাংবাদিকদের বলেন, বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে ধান কেটে জমিতেই পাড়ন দিয়েছিলেন। আঁটি বেঁধে ওই ধান ঘরে তোলার আগেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ফলে ধান আর ঘরে তোলা যায়নি। বিলের পানিতে ধান এখন ভাসছে। এই ধানে চারা গজাতে শুরু করেছে। গোদাগাড়ী উপজেলার বামলাইন বিলের কৃষক আনিসুর রহমান বলেন, বিলে এখন হাঁটুপানি। তার তিন বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে।

শিষের ধানেই এখন চারা গজাচ্ছে। নওগাঁর মান্দা উপজেলার বিভিন্ন বিলের জমির বোরো ধান এখনো তলিয়ে আছে। মান্দার নুরুল্লাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আহসান হাবীব সাংবাদিকদের বলেন, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে অনেক জমির ধান তলিয়ে গেছে। রোদ না থাকায় শিষ ধান থেকে বীজ বের হচ্ছে।

এই ধানের ফলন কম হবে বলে কাটার জন্য শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষকের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বগুড়ার আদমদিঘীর কৃষক কৃষক ইদ্রিস আলম জানান, মূলত ওইসব জমিতে আমন ধান কাটার পর সরিষা ও আলুর আবাদ করা হয়েছিল। এ কারণে কিছুটা দেরি হয়েছিল বোরো ধান রোপণ করতে।

আবার অনেকে কাটারি ধান রোপণ করেছিল। এই জাতের ধান পাকতে ও কাটতে বেশি সময়ের প্রয়োজন পরে। ফলে অনেক কৃষকই ধান কাটতে ও ঘরে তুলতে পারেনি। আর এদিকে জ্যৈষ্ঠের প্রথম থেকেই টানা বৃষ্টিতে ধান কাটায় বাগড়া পড়ে। পাকা ধান ঘরে তুলতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।

আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, ১৯ মে দিবাগত রাত থেকে রাজশাহী অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ২০ মে ৫ দশমিক ৬ মিলিমিটার, ২১ মে ৩৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার, ২২ মে ৮৪ মিলিমিটার, ২৪ মে ৩১ দশমিক ৮ মিলিমিটার, ২৫ মে ১৫ মিলিমিটার, ২৬ মে ২৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সবশেষ গতকাল সোমবার সকাল ৬টা থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ১৬ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে, বরেন্দ্র অঞ্চলের বৃষ্টিতে কৃষকের খুব একটা ক্ষতি হবে না বলে জানিয়ে রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা গণমাধ্যমকে বলেন, রুক্ষ বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিতে খুব বেশি সমস্যা হয় না। আর আমাদের রাজশাহী জেলায় ইতিমধ্যে ৭৫ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। বাকি ধানগুলোও দ্রুতই কাটা শেষ হয়ে যাবে। বৃষ্টিতে ক্ষয়ক্ষতি তেমন হবে না। ঝড় ছাড়া বৃষ্টি হলে ক্ষয়ক্ষতির কোনো হিসাব সংগ্রহ করা হয় না বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড.  আজিজুর রহমান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যদি ঝড় এবং ভারি শিলাবৃষ্টি হয়, তখন আমরা ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করি। এ ধরনের বৃষ্টিপাতের কারণে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব সংগ্রহ করা হয় না। আমরা মাঠপর্যায়ে খোঁজ রাখছি। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি অঞ্চলের চার জেলা- রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরে চলতি মৌসুমে ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ লাখ ৭৯ হাজার ৪৫ টন।

চাঁপাই জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপ-পরিচালক ড. ইয়াসিন আলী বলেন, কয়েকদিনে জেলায় ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এতে জেলা সদর, নাচোল, গোমস্তাপুর, ভোলাহাটের বেশ কিছু জমির ধান নষ্ট হয়েছে। খুব শিগগির ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে পাঠানো হবে। প্রণোদনার মাধ্যেমে তাদের সহায়তা করা হবে। বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা কৃষি অফিসার মিঠু চন্দ্র অধিকারী জানান, এ বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। দাম বেশি পাওয়ায় সন্তুষ্ট এ অঞ্চলের কৃষকরা। অনেক কৃষকই জমিতে দেরিতে ধান রোপণ করেছেন। এজন্য অনেক জমির ধান এখনো ঘরে উঠেনি।

Hi-performance fast WordPress hosting by FireVPS