পা হারিয়ে নিঃশব্দ, বেদনায় শিশু তুরাইশা

লালন উদ্দীন, বাঘা থেকে: একটি পাঁচ বছরের নিষ্পাপ শিশুর স্বপ্ন ভরা ছোট্ট জীবনটা যেন মুহূর্তেই থমকে গেল। এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তার ডান পা কেটে ফেলতে হয়েছে।
যে পায়ে ভর করে সে দৌড়ে বেড়াত, খেলত, স্কুলে যে- সেই পা আর নেই। এখন সে শুয়ে থাকে নিঃশব্দ বেদনায়। ছোট্ট চোখে জমে থাকা নানা কথা তার। আমার বাবা কোথায়?, বাবাকে ডাকো, বাবা এলে আমি হাটতে পারবো। মা কোথায় তুমি? ওরা (চিকিৎসক) আমাকে ব্যথা দিচ্ছে। এখনই নিষেধ কর, আমাকে যেন ব্যথা না দেয়।
অথচ ৫ বছর বয়সী শিশু উম্মে তুরাইশা এখনো জানেই না; তার বাবা আর কখনো ফিরবেন না। এই বয়সে যেখানে তার ছিল দুনিয়া দেখার আনন্দ, সেখানে এখন ব্যথা আর যন্ত্রণাই যেন তার সঙ্গী।
সমাজের দায়িত্বশীল মানুষদের উচিত; শিশুটির পাশে দাঁড়ানো। যেন সে কৃত্রিম পা পায়, আবার হাঁটতে শেখে জীবনের স্বপ্নগুলোকে নতুন করে গড়তে পারে।
জাহিদ হাসান শান্তর বাড়ি নাটোরের লালপুর উপজেলার দুড়দুড়িয়া ইউনিয়নের জামতলা গ্রামে। তার বাবা মালয়েশিয়া প্রবাসী এজাহার আলী। তার পাশে শান্তনা দেয়ার মতো কেউ নেই।
শান্তর মা জামিরন বেগম শোকে পাথর হয়ে গেছেন। বাক প্রতিবন্ধী বোন জোবাইদার (২২) চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। ভাইকে হারানোর ব্যথায় সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে আত্মীয়দের শোকের মাতম।
ছোট্ট শিশু তুরাইশা জাহিদ হাসান শান্তর একমাত্র আদরের মেয়ে। স্ত্রী জেসমিন খাতুন (২৩) তিন মাসের অন্তঃসত্বা। এই গর্ভের বাচ্চাটাও আর নেই। সে নিজেও জানে না তার স্বামী জাহিদ হাসান (শান্ত) আর পৃথিবীতে নেই।
গত ১৯ মে সোমবার বাবা ও মায়ের সাথে স্কুলে যাওয়ার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে তুরাইফার পরিবারের সাথে।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার গ্রীন হ্যাভেন স্কুলের শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থী তুরাইফা প্রতিদিনের মতো বাবার মোটরসাইকেল করে স্কুলে যাওয়ার সময় ঈশ্বরদী-বাঘা আঞ্চলিক মহাসড়কের বানিয়াপাড়ায় পৌছালে বাঘা থেকে ছুটে আসা ঢাকাগামী সুপার সনি এক্সপ্রেস তাদের চাপা দেয়। এতে বাবা ও মেয়ে উভয়ের ডান পা হাটু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
সঙ্গে থাকা অন্তঃসত্বা মা জেসমিনের ডান হাত ভেঙে যায়। স্থানীয়রা দ্রুত উদ্ধার করে তাদের প্রথমে বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে বাবা ও মেয়ের অস্ত্রোপচার করে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়।
চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্ততি চলছিল। কিন্তু ওই দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তুরাইফার বাবা জাহিদ হাসান শান্ত।
মারাত্মক আঘাতে জেসমিনের হাত, কোমরের হাড় (পেলভিস) ও পিঠের হাড় (স্কাপুলা) ভেঙে গেছে। মাথায় আঘাত ও মেরুদণ্ডের কশেরুকা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত।
অন্তঃসত্বা মাকে এখনো আশঙ্কামুক্ত বলতে পারছেন না কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। গত ২০ মে শিশু তুরাইফাকে তার মায়ের পাশাপাশি অর্থোপেডিক বিভাগের এক নম্বর ওয়াডের্র বেডে স্থানান্তর করা হয়েছে। সে কথা বলতে পারছে। তবে বেশি মানুষ দেখলে করছে ভয় করছে কান্নাকাটি।
২০১৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য চীনে গিয়েছিলেন জাহিদ হাসান শান্ত। তবে স্নাতক শেষ না করেই দেশে ফিরে এসে বাড়ির পাশে জামতলা বাজারে দিয়ে ছিলেন হার্ডওয়ারের দোকান।
স্ত্রী, সন্তান, বাবা ও মাকে নিয়ে গড়েছিলেন এক সুখের সংসার। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা নিমিষেই সব এলোমেলো করে দিয়েছে।