একজন দুঃখী মানুষ এবং অন্যান্য

অলোক আচার্যের অনুগল্প
অনলাইন ডেস্ক: আফসার সাহেব উঠানের এক কোণে চেয়ার পেতে বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগেই গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশে গোল পূর্ণিমার চাঁদ। তিনি চাঁদের দিকে তাকিয়ে একমনে সিগারেট টানছেন। সেই ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছে সদ্য নামা আঁধারে। ঘরের ভেতরে তার স্ত্রী রাহেলা বানু বেশ উচ্চৈস্বরে চিৎকার করছেন। এর সবটাই আফসার সাহেবকে লক্ষ্য করে। তার অপরাধ তিনি এই ভর সন্ধ্যায় একগাঁদা কুচো চিংড়ি নিয়ে হাজির হয়েছেন।
এ সপ্তাহে একদিনও পাতে বড় মাছ ওঠেনি। রাহেলা বানু অবলীলায় স্বামীর অক্ষমতাকে অস্ত্র বানিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন। এসব খুব কমই তার কানে ঢুকছে। কারণ আজকাল এসব শুনে তিনি অনেকটাই ধাতস্থ হয়েছেন।
কোম্পানির সামান্য একটি অ্যাকাউন্টেন্টের চাকরি করেন। বাজারের অবস্থা তো যা-তা। বড় মাছের দোকানে রাঘব-বোয়ালদের ভিড়। তার সেখানে দাঁড়াবার জো নেই। আফসার সাহেব মনে মনে বলেন, ভালোই তো! বোয়ালের দোকানে রাঘব বোয়ালদের ভিড়! খারাপ কি!
তিনি রাহেলা বানুর কোনো কথার উত্তর দিচ্ছেন না। দিয়েই বা কী হবে? চাইলেই তো একখান প্রমাণ সাইজের মাছ কিনে আনতে পারবেন না। তর্ক করে লাভ কী? এর চেয়ে ভালো চুপচাপ রাতের অন্ধকার দেখা। কয়েকটা জোনাকি ইতোমধ্যেই আফসার সাহেবের এদিক-সেদিক এসে জড়ো হয়েছে। আফসার সাহেবের ধারণা চাঁদের ভেতরেও কেউ একজন উঠানে চেয়ার পেতে বসে আছে। সেও আফসার সাহেবের মত দুঃখী। তিনি চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
পরিণতি
হরেন বাবুর স্ত্রী সুরবালা দেবী দীর্ঘ রোগ-ভোগ শেষে শেষরাতে পরলোকে পাড়ি জমালেন। তার ছেলেমেয়েরা থাকে দূর-দূরান্তে। হরেন বাবু ভাবলেন, এখন যদি ওদের মায়ের মৃত্যুর খবরটা দিই, তাহলে বেচারারা তাড়াহুড়ো করে রওয়ানা হবে। এতে পথে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। মা অসুস্থ থাকলেও তো ছেলেমেয়েরা গত তিন বছরেও আসার সময় পায়নি। আজ আর এত তাড়াহুড়ো করে লাভ কী? এই ভেবে হরেন বাবু মিথ্যা করে স্ত্রীর মৃত্যুর খবরটা এখন-তখন অবস্থা বলে জানিয়ে দিলেন।
মুহাম্মদ রিয়াজের গল্প: শেষরাতের ঘটনা
সুবর্ণ সন্ধ্যা
খবর শুনে ছেলেমেয়েরা যে যেখানে ছিল এক গাদা ফল-মূল নিয়ে হাজির হলো মাকে দেখতে। হাজার হলেও মায়ের শেষ সময়ে আসতে হবে তো! সবাই যখন পৌঁছায়; তখন তাদের মা সুরবালা দেবী বাড়ির উঠানে পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন। তার সন্তানদের দেখার আগ্রহ শেষ হয়েছে গত রাতেই। তার আগ পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের দেখার জন্য মনটা আকুলি বিকুলি করেছে। কিন্তু ওদের কাজের যে অনেক চাপ! মার জন্য মাসে মাসে ক’টা টাকা পাঠিয়েই দায়িত্ব সেরেছে।
ছেলেমেয়েরা আর তখন কী করবে? সাথে আনা ফলগুলো মায়ের খাট শয্যার পাশে নামিয়ে রাখে। একসময় মৃতদেহ শ্মশানে নেওয়ার সময় হয়। লাশ কাঁধে তুলে রওয়ানা দেন সবাই। হরেন বাবু তখন কাঁদতে কাঁদতে ফলগুলো দেখিয়ে বলেন, ‘তোমরা ওর খাটে সব ফল তুলে দাও।’ কথামতো সব ফল তোলা হয় সুরবালা দেবীর খাটিয়ায়।
আইসক্রিম
চৈত্রের কাঠফাঁটা রোদ। চারিদিক রুপার মতো চকচক করছে। দুপুরবেলায় সেই রোদের তীব্রতা আরও বেড়েছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। সেই রোদ ভেদ করে দ্রুতই একটি কণ্ঠস্বর শোনা যায়। ‘অ্যাই আইসক্রিম নিবেন, আইসক্রিম! নারকেলি আইসক্রিম! বুক ঠান্ডা করা আইসক্রিম!’
আইসক্রিমওয়ালার হাকডাকে অনেকেই ঘর থেকে বের হয়। আইসক্রিম কিনে নেয়। তাদের বুক ঠান্ডা হয়। আইসক্রিমওয়ালা বাক্সের ভেতরে তাকিয়ে দেখে তখনও বেশ কিছু রয়ে গেছে। সেগুলো বিক্রি করতে হবে। না হলে পরদিন আইসক্রিম পাওয়া যাবে না। তার বুকটাও তখন আইসক্রিমের জন্য হাহাকার করছিল। সে আশা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো। হাক দিলো ‘অ্যাই আইসক্রিম!’