আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের নতুন কৌশল গ্রহণ সময়ের দাবি
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশ এক দীর্ঘমেয়াদি মানবিক সংকটের ভার বহন করে চলেছে। ২০১৭ সালের ভয়াবহ সহিংসতার পর প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে যে উদারতা ও মানবতা দেখানো হয়েছিল, তা আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হলেও বাস্তব পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে জটিল ও বহুমাত্রিক। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছে, যার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, এবার তাদের ওপর প্রধান নির্যাতনকারী হয়ে উঠেছে আরাকান আর্মি। প্রতিদিন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে শতাধিক রোহিঙ্গা, যাদের মধ্যে রয়েছে নির্যাতনের শিকার নারী, শিশু ও যুবক। যারা আসছে তারা শুধু নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে না, বরং পেছনে রেখে আসছে সহিংসতা, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র।
বর্তমানে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থান সংকট চরমে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা নতুনদের জন্য জায়গা বরাদ্দ চেয়ে অনুরোধ জানালেও, বাস্তবতা হলো-বাংলাদেশের আর কোনো জায়গা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আপাতত কমিউনাল সেন্টারগুলো সংস্কার করে সেখানে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
প্রশ্ন হচ্ছে-এই সংকট কি শুধুই মানবিক, নাকি এর কূটনৈতিক দিক আরও জোরালোভাবে বিবেচনায় আনা দরকার? একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সীমান্তে অনুপ্রবেশ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেমন জরুরি, তেমনি রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকাংশ এখনো পর্যবেক্ষক ভূমিকা পালন করছে, যেখানে জরুরি ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ ও মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ।
আরাকান আর্মির হাতে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নির্যাতনের খবর-যেখানে তাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার, অর্থনৈতিক শোষণ এবং যৌন সহিংসতার ঘটনা শোনা যাচ্ছে; তা মানবাধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন। এসব প্রমাণ করে, মিয়ানমারে শুধু রাজনৈতিক সংকট নয়, বরং জাতিগত নিধনের নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশকে শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, এখন একটি কূটনৈতিক যুদ্ধও লড়তে হচ্ছে। এ সংকট সমাধানে জাতিসংঘ, ওআইসি, আসিয়ানসহ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মঞ্চগুলোতে আরও সক্রিয় ও জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা জরুরি।
পাশাপাশি, অনুপ্রবেশ বন্ধে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের নতুন কৌশল গ্রহণ করা সময়ের দাবি। রোহিঙ্গা সংকট আর কেবল মানবিক শরণার্থী ইস্যু নয়, এটি এখন জাতীয় নিরাপত্তা, কূটনৈতিক ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের পরীক্ষা। সংকটের দীর্ঘায়ন শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি অশনি সংকেত।