চারঘাটে গ্রামীণ ঐতিহ্য পাতকুয়া বিলুপ্তির পথে

মোজাম্মেল হক, চারঘাট থেকে: রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় বিলুপ্তির পথে প্রাচীন ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে একটি পাতকুয়া। এক সময় মানুষের পান করার জন্য সুপেয় পানির উৎস ছিল কুয়া।
বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে গ্রামবাংলার মা-বোনের কলসি নিয়ে কুয়া থেকে পানি নিয়ে আসার চিত্র তেমন দেখা যায় না। অথচ এই কুয়া বা ইন্দীরাই এক সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং পানযোগ্য পানি পাওয়ার একমাত্র ভরসা ছিল গ্রামের সবার কাছে। কুয়া সাধারণত ইঁদারা, ইন্দিরা, ইন্দ্রা, কূপ ও পাতকুয়া বিভিন্ন নামে পরিচিত।
১০-১৫ ফুট গোল গর্ত করে অন্তত ৫০-৬০ ফুট নিচ পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে এসব কুয়া তৈরি করা হতো। মাটির নিচের পানির স্তরই ছিল এসব কুয়ার পানির প্রধান উৎস। কুয়ার নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত চারপাশ ইট বা রিং (সিমেন্ট-বালুর তৈরি গোলাকার কাঠামো) দিয়ে বাঁধাই করা হতো।
৯০ দশক পর্যন্ত অনেক এলাকার মানুষ তাদের সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করতো এসব গভীর কুয়া থেকে। এসব কুয়ার পানি হতো স্বচ্ছ ও ঠাণ্ডা। সুপেয় পানি পানের অভাববোধ থেকেই মানুষ খনন করতো গভীর কুয়া। খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর থেকে সংগৃহীত পানি দিয়ে ঘর-গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় কাজ করতো।
গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কুয়াগুলো কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। যা এখন শুধুই স্মৃতি। এখন আর বাড়ি বাড়ি কুয়া দেখতে পাওয়া যায় না।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের জীবনমান উন্নত হচ্ছে, হারিয়ে গেছে প্রকৃতির সান্নিধ্য। পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ব্যবহার করছে কত রকমের নামি-দামি কোম্পানির ফিল্টার কিংবা পানি বিশুদ্ধ করছে ফুটিয়ে। অথচ ৯০ দশক পর্যন্ত কুয়ার পানির ব্যবহার ছিল সবর্ত্রই।
সরেজমিনে গিয়ে এ বিষয়ে এলাকার প্রবীণদের সাথে সাথে কথা বলে জানা যায়, চারঘাট উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে একসময় এই কুয়ার ব্যাপক প্রচলন ছিল। এখনো কোন কোন এলাকায় কুয়ার পানি ব্যবহার হচ্ছে। এর সংখ্যা একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য। কেউ বাপ দাদার স্মৃতি বিজরিত কুয়া টিকিয়ে রাখতে এখনো ব্যবহার করছেন। কেউ বা ঐতিহ্য ধরে রাখতে একান্ত সখের বসে।
এখন সকল এলাকাতেই সবার বাড়িতে টিউবওয়েল রয়েছে। এর মধ্যে অনেকের বাড়িতে বিদ্যুৎ চালিত মোটার রয়েছে। ফলে কুয়া হারিয়েছে তার গুরুত্ব।
তারা আরও বলেন, এক সময় নিরাপদ সুপেয় পানির অভাব মিটানো হতো। গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে কুয়া থাকত। একটি কুয়া থেকে আশপাশের বাড়ির মানুষরাও পানি নিয়ে যেত লাইন ধরে। নারীরা কোমরে মাটির কলশি নিয়ে পানি নিতে আসত। মাটির হাড়ি বা টিনের তৈরি বালতিতে রশি লাগিয়ে বাঁশের মধ্যে বেঁধে কুয়ার ভিতরের গর্তে ফেলে পানি উঠানো হয়।
আর এসব পানি পান করা এবং রান্না সহ সকল ধরনের কাজ করা হতো। তখনকার সময়ে মেয়ে বিয়ে দেয়া হলেও দেখা হতো ছেলের বাড়িতে পানির কুয়া আছে কি না। মিয়াপুর গ্রামের লতিফ মিয়া বলেন, আমার বাড়িতে কুয়া ছিলো। কুয়ার পানিও ব্যবহার করতাম। কিন্তু পানি তুলতে পরিশ্রম বেশি, তাই বিগত আট বছর ধরে আর ব্যবহার করি না। ছোট বাচ্চাদের পরে যাওয়ার ভয়ে এটি বন্ধ করে দিয়েছি।
সরদহ ইউনিয়নের খোর্দ্দগোবিন্দপুর গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই আমি এই কুয়া দেখে আসছি। এর গভীরতা অনেক। পানি বেশ ঠাণ্ডা ও স্বচ্ছ। এক সময় এলাকার সবাই এ কুয়ার পানি পান করতাম। আগে পানির স্তর ভূগর্ভের নিচে নেমে গেলে এ কুয়ার ওপরই নির্ভর করতে হতো।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন চারঘাট উপজেলার সভাপতি কামরুজ্জামান বলেন, এখনও যেসব কুয়া টিকে আছে, সেগুলো সংরক্ষণ করা গেলে মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করা যাবে বলে তিনি জানান।