স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহীর অন্যতম অর্থকরি ফসল পান পাতায় এবার পোকার আক্রমন দেখা দিয়েছে। এর আগে দেখা দিয়েছিল পান গাছে কাণ্ড পচাঁ রোগ। এতে করে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এই অঞ্চলের পানচাষিরা।
সম্প্রতি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে রাজশাহীর মিষ্টি পান। কিন্তু এই পানের রস চুষে খাচ্ছে ‘চিনিপোকা’। এটি এক ধরনের মাকড়সার ডিম। দেখতে চিনির দানার মতো। পানচাষিরা নাম দিয়েছেন চিনিপোকা। এই পোকা পান পাতার কাণ্ড, ডগা ও পাতায় দল বেঁধে রস চুষে খায়। এতে পাতার গায়ে ছোট ছোট বাদামি দাগ দেখা দেয়।
ভালো মানের এক আঁটি (৬৪টি পাতা) পানের দাম ১২০ টাকা। তবে চিনিপোকায় আক্রান্ত পান বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২০ টাকায়। চিনিপোকা দমনের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ না থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চাষিরা। হাতুড়ে পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষিরা পোকা দমনের চেষ্টা করছেন। কৃষি বিভাগ থেকেও তাঁরা তেমন কোনো পরামর্শ পাচ্ছেন না।
রাজশাহীর মোহনপুর, দুর্গাপুর, পবা, বাগমারা ও পুঠিয়ায় তিন বছর ধরে এই পোকার উপদ্রব বেড়েছে। চাষিরা বারবার চেষ্টা করেও পোকা দমন করতে পারছেন না।
কীটনাশক থেকে শুরু করে ঘরোয়া নানা উপায় ব্যবহার করেও কোনো কাজে আসছে না। মোহনপুর উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের পানচাষি আফসার আলীর ২০ শতাংশ জমিতে পান চাষ করেছেন। তাঁর সবটাতেই চিনিপোকার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। পানপাতার নিচে এই পোকা ডিম দেয়।
ওপর থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। পাতা উল্টালেই তা চোখে পড়ছে। পোকার আক্রমণে তাঁর বাগানের পান জরাজীর্ণ হয়ে গেছে।
আফসার আলী বলেন, ‘নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নাই। যে যা বলছেন, তাই দিচ্ছেন। কোনো কাজ হচ্ছে না। কীটনাশক দিলে মনে হচ্ছে মরে গেছে। কিন্তু আবার হচ্ছে। এই পান হাটে বিক্রি করতে গিয়েও দাম পাওয়া যাচ্ছে না। ২০ টাকা আঁটি বিক্রি করতে হচ্ছে। যেখানে ভালো পান ১২০ টাকা আঁটি বিক্রি হচ্ছে।’ চাঁদপুর গ্রামে অনেক পানবরজ।
শনিবার সকালে গ্রামের পানচাষি আফাজ উদ্দিন ও আলতাব উদ্দিনের বরজে গিয়েও একই অবস্থা দেখা যায়। আলতাব উদ্দিন বলেন, ‘এটা খুব ভয়ানক পোকা। এখন এমন কোনো বরজ নেই, যেখানে এই পোকা নেই। পাতার রস চুষে পাতাকে দুর্বল করে ফেলে। ফলে অনেক পাতা হলুদ হয়ে ঝরে যায়, উৎপাদন কমে যায়।’
পবা উপজেলার কালুপাড়া গ্রামে শহীদুল ইসলামের বরজেও চিনিপোকার আক্রমণ হয়েছে। তিনি বললেন, কীটনাশক কিংবা নিমতেল, ডিটারজেন্ট, এমনকি উকুননাশক ছিটানোর পরেও কাজ হয়নি। ১০ দিনের জন্য পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। রাজশাহীতে বর্তমানে সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়।
প্রতিবছর বরজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার পান বাজারে আসে। রাজশাহীর মিষ্টি পান শুধু দেশে নয়, বিদেশেও পরিচিত। এ কারণে চিনিপোকার আক্রমণ শুধু চাষির অর্থনীতিতেই নয়, প্রভাব ফেলছে স্বাস্থ্যেও। কারণ, আক্রান্ত পাতায় পোকা দমনে ব্যবহৃত রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ থেকে যেতে পারে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে সালমা বলেন, পান সরাসরি খাওয়া হয় বলে কীটনাশক ব্যবহারে সতর্কতা জরুরি। চাষিদের গুল, নিমতেল, হ্যান্ডওয়াশ ও শ্যাম্পু দিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে দমন পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এই পোকা দমনের কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম মনজুর হোসেন বলেন, মাকড়সা সহজে মরে না। একে মারার জন্য বাজারে যে ধরনের কীটনাশক পাওয়া যায় সবই ভয়ংকর। এগুলো ব্যবহার করা পান খেলে মানুষের কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ জন্য অন্য কায়দায় এই পোকা নিধন করতে হবে, যাতে স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি না হয়।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সাবেক মহাব্যবস্থাপক আরিফ হোসেন রাজশাহীর পান নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তিনি এই পোকার ব্যাপারে অবগত। তিনি বলেন, এক ধরনের মাকড়সা পান পাতায় ডিম দেয়।
দেখতে চিনির দানার মতো। দমন করার নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। চাষিরা পাঁচ টাকার গুল, অর্ধেক পাতা সার্ফ এক্সেল ও ৫০ গ্রাম সালফারজনিত ছত্রাকনাশক ১৬ লিটার পানিতে মিশিয়ে ছিটিয়ে উপকার পাচ্ছেন।