রাজশাহীতে তীব্র গরমে কদর বেড়েছে হাতপাখার

মোজাম্মেল হক: উত্তরের জেলা রাজশাহীসহ দেশজুড়ে চলছে দাবদাহ। এর সঙ্গে লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে রাজশাহী শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত।
গরমের এই সময়ে রাজশাহী নগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ফেরি করে হাতপাখা বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে। এতে এসব হাতপাখার কদর বেড়েছে অনেকগুণ।
বৈদ্যুতিক ফ্যানের বিকল্প হিসেবে হাতপাখার ব্যবহার বহুদিনের। বিশেষ করে গ্রামীণ জীবনে তাল ও কেওয়া পাতার তৈরি এই পাখাগুলোর রয়েছে ঐতিহ্য।
তালপাতা কেটে শুকিয়ে তাতে আল্পনার মতো নকশা করে তৈরি করা হয় একটি ধরণ। আবার কেওয়া পাতার পাখা বাঁশের কঞ্চি ও সুতা দিয়ে তৈরি হয়। অসহ্য গরমে হাতপাখার চাহিদা মেটাতে তাই পাখা পল্লীতে বেড়েছে কর্মব্যস্ততা।
গরমে মানুষকে একটু শান্তির পরশ দিতে দিন রাত পরিশ্রম করে তৈরি করছে হাতপাখা বা তালপাখা কারিগররা। পূর্ব পুরুষের ব্যবসা করে এখনো সংসার চালাচ্ছে প্রায় অর্ধশত পরিবার। গরম শুরুর সাথে সাথে তাদের কাজ বেড়ে গেছে।
সরেজমিনে চারঘাট উপজেলার নিমপাড়া ইউনিয়নের ফকিরপাড়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিন হাজার-হাজার হাত পাখা তৈরি হয় এ জন্যই নাম হয়েছে ‘পাখা পল্লী’।
গ্রামের নারী-পুরুষ মিলিয়ে হাতপাখা তৈরি করেই এখন চালাচ্ছে সংসার। গরম আবহাওয়ার কারণে এখন ব্যস্ত সময় পার করছে পাখার কারিগররা।
পাখা বানানোর কারিগর হাওয়া বেগম বলেন, বুদ্ধি পড়া থেকে পাখা বানানো দেখছি। যা এখন পর্যন্ত চলমান আছে। তাদের কোন জমিজমা নেই পাখা বানিয়ে তাদের সংসার চলে। পাখা তৈরিকারি মজিবুর রহমান বলেন, তাদের পূর্ব পুরুষরা এই তালপাখা তৈরি করে জীবন জীবিকা চালাতো। ফলে তারাও পূর্ব পুরুষের কাজটি ধরে রেখেছেন।
তিনি জানান, প্রায় ৫০টি পরিবার পাখা তৈরির কাজ করে থাকেন।
পাখা বানানো কারিগর ইসমত আরা বলেন, আমার বিয়ের পর শাশুড়ির কাছ থেকে গল্প শুনেছি আমার দাদা শ্বশুরের আমল থেকে এই হাত পাখার কাজ করে আসছে। এই হাত পাখা তৈরি করে আমাদের সংসার চলে। এখন গরমের কারণে অনেক বেশি কাজের চাপ পড়ে গেছে পাখা বানানোর।
নাটোর থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন জানান, তালপাখা এলাকার ক্রেতাদের কাছে রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। প্রতিটি বাড়িতে পাখা তৈরি কাজে এত ব্যাস্ত যে কারও কথা বলার সময় নেই। কাজের চাপে অনেকে সকালে ভাত খায় আর রাতে খায়। কাজের চাপের কারণে তারা ভাত খাবার পর্যন্ত সময় পায় না।
পাখা করিগর নজরুল ইসলাম জানান, পাখা তৈরির প্রধান উপকরণ তালপাতা সংগ্রহ করা হয় শীতকালে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা পাতা সংগ্রহ করে। এই তালপাতা এনে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর পাতা ভিজে নরম হয়ে গেলে পানি থেকে উঠিয়ে তা কেটে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
গতকাল শনিবার রাজশাহীতে তাপমাত্রার পারদ উঠেছিল ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বুধবার বেলা তিনটার দিকে জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করে রাজশাহী আবহাওয়া অফিস।
এটি চলতি মৌসুমের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর আগে গত ২৮ মার্চ ৩৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে সর্বশেষ ১৮ এপ্রিল ২ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
এর আগে জেলাটিতে চলতি বছরের সর্বোচ্চ ২৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। গত ১৮ এপ্রিল বৃষ্টির পর দুই দিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। গত দুই দিন তাপমাত্রা কম থাকলেও গরমের তীব্রতাও ছিল।
পাখা তৈরির কারিগররা জানান, একটা পাতায় দুটো পাখা হয়। এই পাতা পুনরায় বেঁধে রাখা হয়। এভাবে রাখার পর গরমের মৌসুম আসার সাথে সাথে সেগুলো আবার পানিতে ভিজতে দেয়া হয়। পানিতে দেবার পর পাতা নরম হয়ে গেলে শুরু হয় মূল পাখা তৈরির কাজ।
পানিতে ভিজে নরম হয়ে যাওয়া পাতা ছাড়িয়ে পাখা আকৃতির করে চারিদিক কেটে সমান করে থাকে ছেলেরা। বাড়ির মেয়েরা সেগুলো বাশের সলা দিয়ে বেঁধে ফেলে। পরিবারের ছোট সদস্যরা এগুলো সুচ আর সুতা দিয়ে সেলাই করে থাকে। এভাবে ব্যবহারের উপযোগী একটি তালপাখা তৈরি হয়।
বাড়ির ছেলে, মেয়ে, শিশুরা ও গৃহবধূরা সবাই মিলে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১/২টা পর্যন্ত পাখা তৈরির কাজে ব্যাস্ত থাকেন। গৃহবধূরা জানায় তারা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দু’বেলার খাবার রান্না করে রাখে। দুপুরে গৃহবধূরা কেউ রান্না করে না।
তারা সকাল ও রাতে রান্না করে। নজরুল আরও জানান, তাদের তৈরিকৃত পাখা পাইকারী ও খুচরা বিক্রি করা হয়। এখান থেকে পাইকারিরা প্রতি পিস পাখা ১২ থেকে ১৫ টাকা দরে ক্রয় করে নিয়ে খুচরা ২০ থেকে ২২ টাকায় বিক্রি করে।
মূলত পাখা ব্যবসা থাকে গরমের ৩ থেকে ৪ মাস। এই পাখা শুধু এলাকায় নয় কুষ্টিয়া, রাজশাহী, নাটোর, চাপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়িীরা এসে পাইকারি দরে পাখা কিনে নিয়ে যায়।
পাখা পল্লীর কারিগররা জানান, সরকারি সহযোগিতা বা স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হলে এই পেশাকে আরও উন্নত করতে পারবে বলে তারা বলেন।