আতাইকুলা গণহত্যা: লাশের নিচে পড়েও আজ বেঁচে আছি

এসএম সাইফুল ইসলাম, রাণীনগর থেকে: নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের এক হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম আতাইকুলা। এই গ্রামের সুরেশ্বর পালের ছেলে প্রদ্যুৎ কুমার পাল সেই সময়ে তিনি এসএসসি পরীক্ষার্থী। বর্তমানে তার বয়স ৭৫। গণ কবরের ছবি তুলতে গিয়ে দেখা হয় প্রদ্যুৎ কুমার পালের সঙ্গে।
তার দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল রোববার পাক হানদার বাহিনীর ১১৪ জন ও তাদের স্থানীয় দোসর ও বিহারী মিলে প্রায় ২শ জন প্রকাশ্যে দিবালোকে সকাল ৯ টার দিকে নওগাঁর ছোট যমুনা নদী পার হয়ে আমাদের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম ঘিরে ফেলে। এক পর্যায়ে তারা বিভিন্ন বাড়িতে প্রবেশ করে পুরুষদের ধরে নিয়ে প্রথমে স্থানীয় স্কুল মাঠে জরো করে। এরপর তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক পুরুষ শুন্য বাড়িতে ঢুকে লুটপাট, অগ্নী-সংযোগ ও নারী নির্যাতন করে।
এক পর্যায় পাক-বাহিনীরা স্কুল মাঠে জরো করা গ্রামবাসীদের দুই ভাগে ভাগ করে। এক পাশে জরো করলো যারা টাকা পয়সা দিবে তাদের, অন্য পাশে রাখলো যারা টাকা-পয়সা দিবে না তাদের। টাকা-পয়সা স্বর্ণালঙ্কার না দেয়ার দলে ছিলাম আমি। দুপুর গড়িয়ে বিকাল ৩টার দিকে ৫২জনকে লাইন করে আমাদের বাড়ির বারান্দায় নিয়ে আসে।
পরে তারা দুই তালা ভবনের ওপরে ওয়ারলেস সেট করে সেখান থেকে নওগাঁতে পালপাড়া গ্রামের হিন্দুদেরকে নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উর্দু ভাষায় আদান প্রদান হচ্ছে এমনটা আমি শুনতে পাচ্ছি। তারা আগে থেকেই বারান্দায় তাক করে রেখে ছিলো দুটি এলএমজি।
নওগাঁ ক্যাম্পের হুকুম পেয়ে তারা অসহায় গ্রামবাসীদের ওপর ফায়ার শুরু করে। প্রথম গুলিটাই আমার বাবা সুরেশ্বর পাল ও আমার কাকাকে লাগলে দুই জনই আমার ওপর পরে গিয়ে জল জল করে বাঁচার জন্য আত্ন-চিকৎকার শুরু করে।
আর আমাকে চুপ থাকতে বলে। আমি তখন ছোট মানুষ হওয়ায় দুই লাশের নিচে পরে যাই। এরপর সারিবদ্ধ সবাইকে ব্রাশ ফায়ার করে ৫২ জনকে নির্বিচারে হত্যা করে। এই লাশের স্তুপ আর রক্তের নহরের মধ্যে থেকে দেখতে পাই শুধু লাশ আর লাশ।
আমার পুরো শরীর রক্ত আর লাশের নারী-ভূরির স্তরে জমাট বেধে গেছে। শ্বাস-নিশ্বাস জোরে ফেলতে পারিনি। শুধু মাত্র সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে বাঁচার আকুতি করেছি। আমি তিন ঘণ্টা কোন প্রকার নরা-চড়া বাদে একই অবস্থানে লাশের স্তুপের নিচে পড়ে ছিলাম। লাশের স্তুপের নিচ থেকে উঠে দেখি আমার চারপাশে লাশ আর লাশ।
এদিকে গ্রামের মধ্যে চলছে পিতা হারা পুত্র হারা মানুষদের আর্তনাত ও নারীদের চিৎকার বিভিষিকাময় এক দৃশ্য এসময় পাক-বাহিনীর গুলিতে মারা যায় সুরেশ্বর পাল, সতীশ চন্দ্র পাল, যুগেশ্বর চন্দ্র পাল লংকেশ্বর চন্দ্র পালসহ ৫২ জন। ৫২জনের মধ্যে আমার পরিবারেরই ছিলো ৫জন। সন্ধ্যা ছয় টার পর লুটপাট, ভাঙচুর, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ শেষ করে ধ্বংস লীলা চালিয়ে পাক সেনারা নওগাঁর শহরের উদ্দেশে নদী পার হয়ে চলে যায়।