বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পদ্মার মা মাছ ও জলজ প্রাণী

কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহার
মোজাম্মেল হক, চারঘাট থেকে: বর্ষাকাল ছাড়া সারাবছরই পদ্মা নদী জুড়ে দেখা যায় শুধু ধু-ধু বালু চর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত ৪০ বছরে পদ্মার আয়তন অর্ধেকে নেমেছে। আবাসস্থল হারিয়ে বিলুপ্তি হতে চলেছে বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী।
যে সামান্য কিছু জায়গায় গভীর পানি অবশিষ্ট আছে, সেখানেও কারেন্ট জাল ও বরশি ফেলে নির্বিচারে ধরা হচ্ছে মা মাছ। এ অবস্থায় শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীর কিছু অংশে মাছ ও জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণার পরামর্শ দিচ্ছেন নদী গবেষকরা। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সালের দিকে পদ্মার গড় গভীরতা ছিল ১২ দশমিক ৮ মিটার।
২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গড় গভীরতা নেমে আসে ১১ দশমিক ১ মিটারে। পদ্মার গভীরতা কমায় সঙ্কটে পড়ছে মাছ ও জলজ প্রাণী। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড কনজারভেশন’ ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় এ গবেষণা তথ্য উঠে এসেছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চারঘাটের সারদা পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটার অংশ নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
সরেজমিন চারঘাট উপজেলার রাওথা, বাঘা উপজেলার মীরগঞ্জ ও গোদাগাড়ী এলাকার হরিশংকরপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা দেশের বৃহত্তম নদী তা চেনার উপায় নেই। চারিদিকে ধু ধু বালু চর। এর মাঝে কিছু জায়গায় পানি দেখা যাচ্ছে।
সে সামান্য পানিতেই কেউ বরশি আবার কেউ কারেন্ট জাল ফেলে মাছ শিকার করছেন। এসব বরশি ও জালে ধরা পড়ছে বিশাল সাইজের বাঘাইড়, পাঙ্গাশ, রুই, কাতলা, চিতল, আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছ। বাঘা উপজেলার মীরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, নদীতে ধু ধু বালুচর, কিছু জায়গায় হাঁটু পানি আর কিছু জায়গায় গভীর পানি রয়েছে।
মা মাছগুলো গভীর পানিতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু বরশি ও কারেন্ট জাল দিয়ে এসব মাছ নির্বিচারে ধরা হচ্ছে। শুধুমাত্র আমাদের ঘাটেই গত কয়েক দিনে অন্তত ২৫টি কাতলা ও চিতল মাছ ধরা পড়েছে। যেগুলোর ওজন ১২-১৮ কেজি। কারেন্ট জালে একটা শুশুকও ধরা পড়েছিল। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন মাছ শিকারে আসছে।
গোদাগাড়ীর হরিশংকরপুর এলাকার জেলে আব্দুল মান্নান বলেন, পদ্মা নদী চেনার উপায় নেই। নদীতে এত কম পানি আর কখনও দেখিনি। আমরা যারা প্রকৃত জেলে তারা হা হুতাশ করছি। অথচ কিছু মৌসুমি জেলে বরশি ও কারেন্ট জাল দিয়ে নির্বাচারে মাছ শিকার করছে।
এভাবে চলতে থাকলে আগামী মৌসুমে পদ্মায় মাছ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। মৎস্য অধিদপ্তর রাজশাহী জেলার তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজশাহীর পদ্মা নদী থেকে মাছ আহরণ হয়েছে ১ হাজার ৮৫০ মেট্রিকটন। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ছিল ২ হাজার ৪০ মেট্রিক টন, ২০২১-২২ এ হয়েছিল ২ হাজার ১৫২ মেট্রিকটন, ২০২০-২১ এ ২ হাজার ২২১ মেট্রিকটন এবং ২০১৯-২০ এ আহরণ হয়েছিল ২ হাজার ২৮৩ মেট্রিকটন। প্রতিবছরই মাছ আহরণের পরিমাণ কমছে। গত পাঁচ বছরে মাছ আহরণ কমেছে ৪৩৩ মেট্রিকটন।
গবেষকরা বলছেন, পদ্মা নদী থেকে হারিয়ে যাওয়া মৎস্য প্রজাতির ৬০ শতাংশই এখন বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির অন্যতম কারণ নির্বিচারে শিকার ও আবাস হারানো। ১৯৮০ সালে পদ্মায় যেখানে ৭১ জেলে মাছ শিকার করতেন, ২০১৯ সালে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬১৬।
প্রায় চার দশকে মাছ শিকারি বেড়েছে প্রায় ৩৮ গুণ। অপেক্ষাকৃত সহজ হওয়ায় প্রতি বছরই একটি বড় অংশের জনগোষ্ঠী যোগ হচ্ছে এ পেশায়। অনেকেই আবার নিষিদ্ধ কারেন্ট জালে মাছ শিকার করছে। এতে নির্বিচারে শিকার হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
এসব কারণে পদ্মার সার্বিক জীববৈচিত্র্যে এসেছে পরিবর্তন। গবেষক দলটিতে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামস মুহা. গালিব। তিনি বলেন, আমরা ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পদ্মার হাইড্রোলজিক্যাল, জলবায়ু ও নৃতাত্ত্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে মৎস্য প্রজাতির সম্পর্কের প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করছিলাম।
পদ্মার মাছ ও জলজ প্রাণীর আশ্রয়ও কমছে। প্রতিনিয়ত নদীর পানি প্রবাহ কমায় শুষ্ক মৌসুমে। জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাবের কারণে এ অঞ্চলের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। অধিকাংশ দেশীয় প্রজাতির মাছ বর্ষাকালে বংশবৃদ্ধি করে। এ সময়ে মাছ শিকার সীমিত করাসহ শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলারও তাগিদ দেন তিনি।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওয়ালি উল্লাহ মোল্লাহ বলেন, পদ্মায় পানির গভীরতা কমেছে, পানির ফিল্টারেশন কমে গেছে। এতে বড় সাইজের রুই, কাতলা, চিতল ধরা পড়ছে। মা মাছ ধরার ব্যাপারে জেলেদের আমরা সতর্ক করছি।
শুধুমাত্র শুষ্ক মৌসুমের জন্য গভীর পানির কিছু অংশকে অভয়ারণ্য ঘোষণার চেষ্টা চলছে। নয়তো পদ্মা থেকে দেশীয় প্রজাতির এসব মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, পদ্মা নদী বড়াল নদের মাধ্যমে সরাসরি চলনবিলের সাথে জড়িত।
পদ্মা নদীতে পানি না থাকায় চলনবিলেও পানি নেই। এর প্রভাব পড়েছে পদ্মার সাথে সংযুক্ত পুরো জীববৈচিত্র্যের ওপর। দেশীয় মাছের বৃহত্তম আশ্রয়স্থল চলনবিল ও পদ্মা নদীর মাছ ও জলজ প্রাণী হুমকি মুখে পড়েছে। সরকারি উদ্যোগে খুব দ্রুত পানি প্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি গভীর পানির জায়গাগুলো অভয়ারণ্য ঘোষণা দাবি জানান তিনি।