সংবিধানে মূলনীতি রাখার পক্ষে না, এনসিপি

অনলাইন ডেস্ক: অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে দলীয় বক্তব্য চাপিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
দেশের সংবিধানের মূলনীতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দলটি। অর্থবিল ও আস্থা ভোটে সংসদ সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তে ভোটের পক্ষে রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকারে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে তারা।
আজ শনিবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে এসব কথা বলেন এনসিপির নেতারা।
আজ সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপ শুরু হয়। শুরুতে সূচনা বক্তব্য দেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। পরে কথা বলেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
বেলা ১১টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক শুরু হয়ে চলে বেলা ১টা ১০ মিনিট পর্যন্ত। মধ্যাহ্নভোজ ও নামাজের বিরতি শেষে বৈঠক আবার শুরু হয় আড়াইটার দিকে।
যার মুলতবি হয় বিকেল সাড়ে ৪টার পর। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দিনের বৈঠকে সংবিধান, বিচার ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হয়। তবে তিন কমিশনের সব সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হয়নি। আগামী মঙ্গলবার বা তার পরে মুলতবি হওয়া বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, ড. বদিউল আলম মজমুদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন। দুপুরের বিরতির পরে কমিশনের আরেক সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক বৈঠকে যোগ দেন।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে আট সদস্যের প্রতিনিধিদলে ছিলেন সদস্যসচিব আখতার হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, জাভেদ রাসেল, মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী, সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব নাহিদা সারোয়ার নিভা।
১৯৭২ সালের সংবিধানে আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় মূলনীতি সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে যুক্ত করেছিল। এরপর সংশোধনীর মাধ্যমে একাধিক রাজনৈতিক দল সংবিধানের মূলনীতিতে দলীয় বক্তব্য যুক্ত করেছিল বলে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘সংবিধানে দলীয় মূলনীতির মাধ্যমে আসলে নিজেদের দলীয় রাজনৈতিক অবস্থানকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা সংবিধানে মূলনীতির প্রয়োজন আছে কি না সে প্রশ্ন রেখেছি যে এই মূলনীতির কাঠামোর বাইরে আমরা অন্য কোনো কাঠামো ভাবতে পারি কি না।
আমাদের সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্রী এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা বলা থাকে মৌলিক অধিকারগুলোর কথাও বলা থাকে। সে ক্ষেত্রে আলাদা করে মূলনীতির প্রয়োজন আছে কি না।’
প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি পদে সর্বোচ্চ দুবারের বেশি কেউ থাকতে পারবে না—সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে এনসিপি। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হওয়া ব্যক্তি কখনো রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না—এমন প্রস্তাবও দলটি করেছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার নয়, বরং মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রস্তাব দিয়েছি। সংবিধান সংস্কার কমিশনের জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের পক্ষে দলটি একমত হলেও কোন প্রক্রিয়ায় তা গঠিত হবে, তা নিয়ে আরও আলোচনার পক্ষে এনসিপি।’
ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে উভয় কক্ষের সদস্য ও জেলা পরিষদের সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সুপারিশ করেছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন।
এনসিপি ইলেকটোরাল পদ্ধতিতে একমত হলেও তাতে উভয় কক্ষের সদস্যদের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারে সব জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে নির্বাচনের পক্ষে। সংবিধান সংশোধনে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনের পাশাপাশি গণভোটের পক্ষে এনসিপি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, নিরবচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। মৌলিক অধিকার আদালত দ্বারা বলবৎযোগ্য করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অধিকারগুলো ধারাবাহিকভাবে নিশ্চিত করা হবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংবিধানের ৭৯ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল ছাড়া অনাস্থা ভোটসহ সব বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে এমপিদের ভোট দেওয়ার ক্ষমতা দিতে বলা হয়েছে।
অনাস্থা ভোটের সুযোগ দেওয়া হলে দেশে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের আশঙ্কা করেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। একই মত এনসিপিরও।
এ বিষয়ে দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা অবশ্যই দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন, এই অধিকার তাঁদের থাকা উচিত। এটাই কার্যকর সংসদের একটা শর্ত।
কিন্তু অর্থবিল এবং অনাস্থা মানে যেটার মধ্যে সরকার পরিবর্তন সংসদকে অস্থিশীল করা হয়; এই দুটো ক্ষেত্র বাদে অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন। আমাদের বিবেচনাটা হচ্ছে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা এবং সরকার সংসদের স্থিতিশীলতা দুটোকে মাথায় রেখে আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ প্রয়োগের কথা বলেছি।’
বাংলাদেশে ক্ষমতার হস্তান্তর সময় রাজনীতিতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে মনে করে এনসিপি। ভবিষ্যতে যাতে তা নয়, সে জন্য এখন থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে দলটি। তবে ওই সময় কারা দায়িত্ব পালন করবে, সেই বিষয়ে আরও আলোচনা হতে পারে বলে মনে করে জুলাই আন্দোলনের নেতাদের নিয়ে গঠিত দলের নেতারা।
এ বিষয়ে দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টা কীভাবে হবেন, সে নিয়ে আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। আমরাও কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছি, যাঁরা এনসিসির সদস্য আছেন, তাঁদের মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেতা এবং রাষ্ট্রপতি বাদ রেখে অন্যদের থেকে কীভাবে নিয়ে আসা যায়। এটা নিয়ে আরও আলোচনার সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি।’
স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে নতুন করে সংসদীয় সীমানা পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব এনসিপি করেছে বলে জানিয়েছে নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘সংসদীয় যে সীমানা রয়েছে, সেটা আমরা বলেছি যে স্বাধীন কমিশন করে—এটা নতুন করে আগের কোনো সীমানায় আমরা যেতে চাই না, বরং নতুন করে এটা নির্ধারণ করতে হবে একটা স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে।’
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। তবে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের পূর্ব অবস্থান তো এটা যে গণপরিষদের মাধ্যমে হতে হবে।’ দলটি ১০০টি নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে বলে মত দিয়েছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, বিচার বিভাগের জন্য আর্থিক স্বাধীনতা দেওয়া এবং বিভাগীয় বেঞ্চ তৈরি করা, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতি, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা এবং সে ক্ষেত্রে উচ্চ পক্ষের মতামত নেওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি।’
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের স্প্রেডশিটে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব না রাখায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এনসিপি।
গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত বিজয়কে বিভিন্নভাবে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, এ দেশের ইতিহাসে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা বারবার পর্যুদস্ত হয়ে একটি ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসনে পরিণত হয়। গণতন্ত্রের সংগ্রামের মাধ্যমে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, বিভিন্নভাবে সে বিজয়কে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে।
১৫ বছরের ফ্যাসিবাদ শাসনকে বিতাড়িত করতে এনসিপি নেতারা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে দাবি করে আলী রীয়াজ বলেন, ‘দীর্ঘদিনের যে ফ্যাসিবাদী শাসন জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের বুকের ওপর বসে ছিল, তার বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়াই, অকুতোভয় সংগ্রাম এবং আপনাদের সাথিদের প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সে শাসনকে পরাস্ত করতে পেরেছেন। একটি ফ্যাসিবাদী শাসনকে পলায়ন করতে বাধ্য করেছেন ৷ যা বাংলাদেশকে রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে অগ্রসর করেছে।’