ঢাকা | এপ্রিল ১৯, ২০২৫ - ৫:৫৪ অপরাহ্ন

হারিয়ে যেতে বসেছে চারঘাটে টুল-পিঁড়িতে বসে চুল-দাঁড়ি কাটা

  • আপডেট: Wednesday, April 16, 2025 - 10:29 pm

মোজাম্মেল হক, চারঘাট থেকে: কালের বিবর্তনে নরসুন্দরদের এই পেশা প্রায় বিলুপ্তির পথে। এক সময় হাট-বাজার ও গ্রামাঞ্চলে পিঁড়িতে বসে চুল-দাঁড়ি কেটে নিতেন সকল বয়সী পুরুষ। বর্তমানে শহর-বন্দর ও গ্রামের হাট-বাজারগুলোতে রয়েছে এসি ও নন-এসি সেলুন। এতে চুল ও দাড়ি কাটার জন্য রয়েছে আধুনিক সাজসরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি।

তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামাঞ্চলের এই ঐতিহ্য। আর এই ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে চুল-দাঁড়ি কাটতে এখনো গ্রামাঞ্চলে ছোটেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সরদহ ইউনিয়নের খোর্দ্দগোবিন্দপুর গ্রামের নরসুন্দর মনোরঞ্জন শীল (৬৬)।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাটিতে বসে ঝিকরা হাটে পিঁড়ি বা টুলে বসিয়ে চুল ও দাড়ি কাটতে। জানা যায়, প্রায় দুই দশক আগে প্রত্যেকটি হাট-বাজারে সারিবদ্ধ ভাবে বসে চুল-দাঁড়ি কাটাতে ব্যস্ত সময় পার করতেন নরসুন্দর পেশাজীবীরা। আর মাটিতে পিঁড়ি-ইটের ওপরে বসে মাথার চুল কেটে নেওয়াসহ দাঁড়ি শেভ করে নিতে সিরিয়ালে অপেক্ষা করতেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার পুরুষেরা। এরপর নিজের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে পর্যায়ক্রমে কাজ করিয়ে নিতেন অপেক্ষমাণ পুরুষেরা।

এ সময় নরসুন্দরদের কেচির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠত নাপিত পট্টি। শুধু হাট-বাজারই নয়, গ্রামাঞ্চলের গাছের ছায়ার তলে নরসুন্দরদের হাঁটুর কাছে মাথা পেতে চুল-দাঁড়ি কেটে নিত শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধরা। সেই সময়ে শেভ করতে ছিল না ব্লেড। লোহার তৈরি ধারালো খুর দিয়ে দাঁড়ি কাটা হতো। আর দাঁড়ি নরম করতে মুখে লাগানো হতো সাবান। কিন্তু কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে এই ঐতিহ্য। এখন আর দেখা যায় না। নরসুন্দরদের হাট-বাজারে সারিবদ্ধ বসে থাকা। এটি এখন দখল করে নিয়েছে হেয়ার কাটিং সেন্টার, সেলুন। যার ফলে সেই সময়ের অনেক নরসুন্দর ছিটকে গেছে এ পেশা থেকে।

নরসুন্দর মনোরঞ্জন শীল জানান, ১৫ বছর বয়স থেকে তিনি এ পেশায় এসেছেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে নরসুন্দর পেশায় জড়িত। আগের দিনে হাট-বাজার ও গ্রামের গাছ তলায় বসে চুল-দাঁড়ি কাটতেন। এ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। কিন্তু এখন আর আগের মত কেউ কাজ করায় না। সবাই বিভিন্ন সেলুনে কিংবা নিজেই বাড়িতে শেভ করে নেন।

তিনি আরও বলেন, উপজেলার খোর্দ্দগোবিন্দপুর, ঝিকরা, পাটিয়াকান্দি, মুংলী সহ বিভিন্ন হাটে গিয়ে টুলে বা পিড়িতে বসে চুল-দাঁড়ি কাটি। জীবিকার তাগিদে এখনো ধরে রেখেছি পেশাটি। এখনো গ্রামাঞ্চলের কতিপয় প্রবীণ পুরুষেরা আমার কাছে আসে। প্রত্যেক জনের চুল কাটা ২০ টাকা ও সেভ করা ১০ টাকা হারে কাজটি করি বলে তিনি জানান। চুল কাটতে আসা মুরশিদ জানায়, ছোট বেলায় হাটের দিনে খোলা আকাশের নিচে চুল বা দাড়ি কাটতো আর এখন আমি নিজেই দীর্ঘদিন ধরেই এখানে চুল কাটাই।

খোর্দ্দগোবিন্দপুর গ্রামের মকবেল হোসেন বলেন, আমরা ছোট বেলায় বাবার সঙ্গে গ্রামের হাটে যেতাম। সেখানে পিড়িতে বসে নাপিতরা চুল কেটে দিত। এখনকার ছেলে-মেয়েদের চুল কাটায় আধুনিক সেলুনগুলোতে। আমরা এখনো এই দৃশ্য নিজের চোখে দেখলেও এমন একটা সময় আসবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিছকই গল্প মনে হবে।

বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম নরসুন্দর বা নাপিত পেশা। গ্রামীণ নরসুন্দরদের এই ঐতিহ্যবাহী পেশাটি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। তবু কিছু মানুষ এই পেশাকে ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিশেষ মূল্যবান।