বিদায় ১৪৩১, স্বাগত ১৪৩২ শুভ নববর্ষ আজ

সোনালী ডেস্ক: আজ বাংলা নববর্ষ ১৪৩২। বিদায় নিল ১৪৩১। বৈশাখের প্রথম সূর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয়েছে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। রাজশাহী, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নানা আয়োজনে, রঙে আর উচ্ছ্বাসে ভরপুর এই দিনটি পালিত হবে ।
নতুন বছরকে বরণ করে নিতে রাজধানীর রাস্তাঘাট, পার্ক, প্রাঙ্গণ, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকবে উৎসবের বর্ণিল হাওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ সকাল ৯টায় শুরু হবে।
একইসঙ্গে সারাদেশের মতো রাজশাহীতেও সকলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, সুন্দর, জাঁকজমকপূর্ণ ও আনন্দঘন পরিবেশে বর্ষবরণ করতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে রাজশাহী জেলা প্রশাসন। জানা গেছে,
নববর্ষ উপলক্ষে আজ সকাল সাতটায় রাজশাহী সিঅ্যান্ডবি মোড় হতে শিশু একাডেমি পর্যন্ত শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। সকাল সাড়ে সাতটায় শিশু একাডেমিতে জাতীয় সংগীত ও ‘এসো হে বৈশাখ’ গান পরিবেশন করা হবে।
সকাল পৌঁনে আটটায় একই স্থানে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা এবং দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হবে। এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য “নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান”। শোভাযাত্রা শুধুমাত্র এক সাংস্কৃতিক উৎসব নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের ভাষাও হয়ে উঠেছে।
শোভাযাত্রায় সাতটি বড়, সাতটি মাঝারি এবং সাতটি ছোট মোটিফ বহন করা হবে, যাতে থাকবে বাঙালির ঐতিহ্য, জীববৈচিত্র্য ও সমাজের নানা অসাম্যের প্রতীকী প্রতিবাদের চিত্র। ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, এমনকি বিদেশি অতিথিরাও অংশ নিচ্ছেন এই আয়োজনে।
শোভাযাত্রাটি চারুকলা থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড়, টিএসসি, শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা হয়ে পুনরায় চারুকলায় গিয়ে শেষ হবে। এত বিশাল আয়োজনে ঢাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে নজিরবিহীন। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানিয়েছেন, পুরো শোভাযাত্রা ও আশপাশের এলাকাকে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে।
মোট ২১টি সেক্টরে ভাগ করে শহরে মোতায়েন করা হয়েছে ১৮ হাজার পুলিশ সদস্য, র্যাব, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থা। প্রতিটি প্রবেশপথে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি, সিসি ক্যামেরা, ড্রোন ও স্ট্যাটিক ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখা হবে। রমনার বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানও আজ অনুষ্ঠিত হবে।
রবীন্দ্রসংগীত, লোকসঙ্গীত ও আবৃত্তিতে ভোরবেলায় গেয়ে উঠবে “এসো হে বৈশাখ, এসো এসো”এই সুরেই জেগে উঠবে বাঙালির প্রাণ। নগরবাসী সপরিবারে ভিড় জমাবে প্রিয় এই আয়োজন উপভোগ করতে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
এক বার্তায় তিনি বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উদযাপন উপলক্ষে সকল দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, “পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী এবং অমূল্য এক উৎসব, যা বাঙালির ঐক্য এবং মহা পুনর্মিলনের প্রতীক।” তিনি আরও বলেন, “এই দিনে মানুষ অতীতের দুঃখ, হতাশা ও বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে একে অপরের সঙ্গে সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব, আনন্দ এবং ভালোবাসার চেতনায় মিলিত হয়।”
অধ্যাপক ইউনূস তার বার্তায় উল্লেখ করেন, মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়েছিল এবং এটি আজকের দিনে সমগ্র বাঙালির জন্য ধর্মনিরপেক্ষ ঐক্যের চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, “এই দিনটি আমাদের সকলকে নতুন প্রত্যয়ে, নতুন উদ্যমে, আগামীর দিকে পদক্ষেপ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে।”
বর্ষবরণ উপলক্ষে আতশবাজি, ফানুস ও উচ্চ শব্দের বাঁশি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দুপুর ২টার মধ্যে সব অনুষ্ঠান শেষ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে আয়োজকদের। বিকেল ৫টার পর সকল স্থানে প্রবেশ সীমিত করা হবে।
পহেলা বৈশাখ বাঙালির চিরায়ত পরিচয় বহন করে। ধর্ম-বর্ণ, জাতি বা শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই এই উৎসবে মেতে ওঠে। এটি কেবল একটি দিন নয়, বরং বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ। নানা প্রতিকূলতা, রাজনৈতিক জটিলতা, নিরাপত্তা ঝুঁকি সবকিছুকে ছাপিয়ে আজ রাজধানীসহ সারাদেশেই উচ্চারিত হবে একটাই সুর: নতুন বছর হোক আলোর, শান্তির ও সম্ভাবনার।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্ষবরণের অনুষ্ঠানমালা: বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কল্যাণে এখন ভোরে রমনা বটমূলে শুরু হওয়া বর্ষবরণের অনুষ্ঠান উপভোগ করে কয়েক কোটি বাঙালি। ছায়ানটের শিল্পীদের পরিবেশনায় বৈশাখকে বরণের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় আগেভাগে।
পহেলা বৈশাখের দিন ভোরেই শুরু হয় বিভিন্ন স্থানে উন্মুক্ত কনসার্ট, বাউল, লালন, জারি-সারি, মুর্শেদী গানের আসর। আর শহুরে অ্যামিউজমেন্ট পার্কের স্বাদ থাকলেও পহেলা বৈশাখের দিন অন্তত নাগরদোলায় চড়তে চায় অনেক শিশুই।
পান্তা-ইলিশ: বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পান্তা-ইলিশ। যেন এ পান্তা-ইলিশ না হলে আর পহেলা বৈশাখের কোনো আমেজই থাকে না। বেশ তো এ সুযোগে রমনার লেকের পাড়েই অনেকে বসে পড়েন ইলিশ-পান্তা খেতে। সঙ্গে থাকে কাঁচামরিচ। মানে সম্পূর্ণভাবেই বাঙালিয়ানার পরিচয় দিতে যেন ব্যস্ত সবাই।
আনন্দ শোভাযাত্রা: বর্ষবরণের অনুষ্ঠানমালায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৮৯ সালে এ শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা যা আগে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে পরিচিত ছিলো।
পহেলা বৈশাখের দিন সকাল গড়িয়ে যখন রমনা টিএসসি শাহবাগে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে, তখন শুরু হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শোভাযাত্রা বের হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
এখানে পশুপাখির মুখাকৃতির ছবিসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গকে ফুটিয়ে তোলা হয় নানা রং-বেরঙের মুখোশ ও আলপনার মাধ্যমে। ছেলে-বুড়ো সবাই তখন মেতে উঠে বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রার আনন্দে। হালখাতা: প্রাচীন বর্ষবরণের রীতির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবেই জড়িত একটি বিষয় হলো হালখাতা।
তখন প্রত্যেকে চাষাবাদ বাবদ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত। এরপর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা তাদের প্রজাসাধারণের জন্য মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন। যা পরবর্তীতে ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানিরা সারা বছরের বাকির খাতা সমাপ্ত করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে বসে দোকানে।
গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। এ উৎসবগুলো সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। এখনো গ্রামগঞ্জে নববর্ষে হালখাতার হিড়িক পড়ে বাজার, বন্দর ও গঞ্জে।
এদিকে, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পহেলা বৈশাখ রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার, সকল হাসপাতাল, শিশু পরিবার ও শিশু সদনে উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাংলা খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা করা হবে। শিশু পরিবারের শিশুদের নিয়ে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং কারাবন্দীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে।
দিবসটি উপলক্ষ্যে দিনব্যাপী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় উদ্যান শিশু-কিশোর, শিক্ষার্থী, প্রতিবন্ধী এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য প্রবেশমূল্য ছাড়া দর্শনের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
এই দিনটি উদযাপনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আজ সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদের মুক্তমঞ্চে বর্ষবরণ ও সকাল সাড়ে ৯টায় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। শোভাযাত্রাটি চারুকলা অনুষদ চত্বর থেকে শুরু হয়ে ক্যাম্পাস প্রদিক্ষণ করবে। এছাড়াও বর্ষবরণে চারুকলা অনুষদ চত্বরে দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
এদিকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে গ্রাম-বাংলার হারানো ঐতিহ্য নিয়ে একক স্ক্রলচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সোবাহান। আজ সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণে ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২ ফুট প্রস্থের এই শিল্পকর্মটি প্রদর্শিত হবে।
দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ড. সোবহান বলেন, দুইমাসের প্রচেষ্টায় ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ও ২ ফুট প্রস্থের একটি স্ক্রলচিত্র অঙ্কন করেছি। স্ক্রলচিত্রটিতে স্থান পেয়েছে দেশের গ্রাম-বাংলার হারানো লোকজ-ঐতিহ্য।
বিভিন্ন উৎসব, কারুশিল্প, মৃৎশিল্প, লোকমেলা, লোকসংগীত, লোকসাহিত্য, ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, শৈশব, মাছধরা, প্রাত্যহিক ব্যবহৃত বিষয়বস্তু । এতো বড় পেইন্টিং বাংলাদেশে এর আগে প্রদর্শিত হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
আরএমপির নিষেধাজ্ঞা: আসন্ন পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে মহানগর এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার নিমিত্ত কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ রাজশাহী মহানগর এলাকায় জনসাধারণের নিরাপত্তার স্বার্থে নগরবাসী ও যানবাহন আরোহীদের অসুবিধা এবং বিরক্তি দূরীকরণের উদ্দেশ্যে রাস্তায় সর্বসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে গান-বাজনা, বাদ্য বাজনা, হর্ন বাজানো, লাউড স্পীকার ব্যবহার এবং শোভাযাত্রা/র্যালিতে বিরক্তির উদ্রেককারী বাঁশি যেমন-ভুভুজেলা এবং আতশবাজি ফোটানো, ফানুস/গ্যাস বেলুন উড়ানো, পটকা ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার, বাইক রেসিং, ডিজে পার্টি, অস্ত্রশস্ত্র বহন, বিষ্ফোরক দ্রব্য বহন, সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়াও, অনুষ্ঠানে আগত ব্যক্তিদের ব্যাকপ্যাক, হাতব্যাগ, লাইটার ও ম্যাচবক্স বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বর্ষবরণ উপলক্ষে আয়োজিত সকল অনুষ্ঠান সন্ধ্যা ৬ টার পূর্বে সমাপ্ত করার অনুরোধ করা হয়েছে। সেইসাথে উক্ত সময়ে অনুমোদিত বারসমূহ বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আরএমপি’র পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।