ঢাকা | মে ৮, ২০২৫ - ১০:২৩ অপরাহ্ন

শিরোনাম

আজ ভয়াল ১৩ এপ্রিল চারঘাট গণহত্যা দিবস

  • আপডেট: Saturday, April 12, 2025 - 11:50 pm

মোজাম্মেল হক, চারঘাট থেকে: রাজশাহীর চারঘাটবাসীর জন্য এপ্রিল শোকের মাস। আজ বেদনাবিধুর ১৩ এপ্রিল, চারঘাট গণহত্যা দিবস। প্রতিবছর এপ্রিল মাস এলেই চারঘাটবাসীকে মনে করে দেয় ১৯৭১ সালে এই দিনে সকালে অস্ত্রে সজ্জিত বর্বর পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলায় চারঘাট উপজেলার থানাপাড়া গ্রামসহ কুঠিপাড়া, গৌরশহরপুর, বাবুপাড়ার প্রায় ২শ নিরস্ত্র বেসামরিক পুরুষ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। নামে ও বেনামে আরও কয়েকশ মানুষ আহত হন। দিনগুলো মনে হলে আজও বুক থর থর করে কেঁপে উঠে।

রাজশাহী জেলার ২৭ কি:মি: দক্ষিণে পদ্মা-বড়াল বিধৌত চারঘাট উপজেলা। চারঘাট উপজেলারই একটি মণোমুদ্ধকর গ্রাম থানাপাড়ায় ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল মঙ্গলবার বেলা ১২টার যা ঘটেছিল সেই ঘটনা। মনে পড়ে বুক ফাড়া আর্তনাদ, চিৎকার, বাঁচাও, বাঁচাও, আবার কখন একটু পানি বলে। হত্যাযজ্ঞ ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ৫ নং ওয়ার্ড কমিশনার আজমল হোসেন মতি। ঘটনার বণর্না করতে গিয়ে তিনি জানান, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে আমার বয়স ১৫।

আনুমানিক প্রায় দুপুরের সময় অস্ত্রে সজ্জিত পাক হানাদার বাহিনী সায়রন বাজিয়ে সারদায় অবস্থিত তৎকালীন পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার লুট করা অস্ত্র উদ্ধার করতে আসে। সারদা আসতে গিয়ে পাক বাহিনী মোক্তারপুর ট্রাফিক মোড় ও সারদা বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বাধাগ্রস্ত হয়ে আধাঘন্টা গুলিবিনিময় হয়। শহিদ হন ইউসুফ, দিদারসহ বেশ কয়েকজন। পাক বাহিনী পুলিশ একাডেমীর ভিতর ঢুকে পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকায় কয়েক হাজার নারী পুরুষ ও শিশু দেখতে পায়। সকলেই ভীত সন্তষ্ট নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ, আত্মরক্ষার্থে গ্রাম ছেড়ে সীমান্তবর্তী পদ্মা নদীর তীরে অবস্থান নেন।

মতি বলেন, আমি আমার বাবা ও বড় ভাইয়ের সাথে নিজের জীবন রক্ষার্থে পদ্মা নদীর ধারে অবস্থান করি। কিছুক্ষণ পরে পাক হানাদার বাহিনী পদ্মার চারপাশে আমাদের ঘেরাও করে। নারী ও শিশুদের একদলে ভাগ করে এবং সকল পুরুষদের আরেকটি দলে ভাগ করে। পুরুষদের অপেক্ষা করতে বলে আর নারী ও শিশুদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন।

শুরু হয় ব্রাশফায়ার, সারি সারি স্বজনের মৃতদেহ, আকাশে কুন্ডুলি পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। শুধু গুলি করেও ক্ষান্ত হননি হানাদার পাকবাহিনী, মৃত্যু নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা। চারঘাটকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করার সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পাকিস্থানী বাহিনী জেনোসাইড শুরু করেন।

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা খুরশীদ আলম শিবলী এই থানাপাড়ার একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। যাকে পাক বাহিনী ধরে পাকিস্থান জিন্দাবাদ বলার জন্য বেয়নেট চার্জ করে। এমনকি তার শরীরের চামড়া ছিলে লবণ দিয়ে পাকিস্থান জিন্দাবাদ বলানোর চেষ্টা করা হয়। শত নির্যাতন করা সত্বেও পাক হায়েনারা শিবলীর মুখ থেকে কোন শব্দ বের করতে পারেনি। অত:পর শিবলীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শিবলী যেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তার নির্মম ও রোমহর্ষক হত্যাকান্ডের কথা শুনতে ও সমবেদনা জানাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে থানাপাড়ায় তার বাড়িতে ভিড় জমায়।

প্রতিটি পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বাবা, ভাই অথবা স্বামী, কেউ না কেউ এই গনহত্যার শিকার হন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে থানাপাড়া গ্রাম বিধবা গ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তৎকালীন ত্রাণ ও পুর্নবাসন মন্ত্রী সুপারিশে দা সোয়ালোজ নামে সুইডিশ সংস্থা থানাপাড়া গ্রামে বিধবা নারী ও মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের আত্ম-কর্মসংস্থান সুযোগ করে দেয় যা আজ অবধি চলমান রয়েছে, যেখানে নির্বাহী পরিচালকের দ্বায়িত্ব পালন করছেন ১৩ এপ্রিল ৭১ এ অলৌকিক ভাবে বেঁচে যাওয়া রায়হান আলী, গোলাম মোস্তাফাসহ শহিদ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রায় ২শ নারী ও পুরুষ।

১৩ এপ্রিল মাস চারঘাটবাসীর জন্য করুণ শোকের মাস। প্রতিবছর এপ্রিল মাস। এলেই চারঘাটবাসীকে মনে করে দেয় ১৯৭১-এর সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা। ‘৭১-এর সেই ভয়াল দিনগুলো মনে হলে আজও বুক থর থর করে কেঁপে উঠে।

১৩ এপ্রিল ঘটে যাওয়া গনহত্যাকে চারঘাট গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং গণহত্যার স্মৃতি স্বরূপ-২০১১ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উদ্যোগে চারঘাট পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে তৈরি হয়েছে ১৭৪ জন শহীদের নাম সম্ভলিত স্মৃতিস্তম্ব। স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী, সারদা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থানাপাড়া সোয়ালোজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির উদ্যোগে যথাযথমর্যাদায় গনহত্যা দিবসটি পালনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহন করে হয়। আজ সেই ভয়াল ১৩ এপ্রিল চারঘাট গণহত্যা পালিত হচ্ছে।

Hi-performance fast WordPress hosting by FireVPS