ঢাকা | এপ্রিল ১৭, ২০২৫ - ১২:৫৬ অপরাহ্ন

রাজশাহীতে অবৈধ যানের দাপট সড়ক-মহাসড়কে

  • আপডেট: Tuesday, April 8, 2025 - 11:04 pm

জগদীশ রবিদাস: রাজশাহীর পবা উপজেলার বায়া এলাকার ষাট বছরের বৃদ্ধা মেম জান। গত ১৯ মার্চ সকালে বাড়ি থেকে বের হন বাজার করার উদ্দেশে। বয়সের ভারে ধির পায়ে এসে পৌঁছান রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের কাছে। পায়ে হেঁটে সড়কটি পার হওয়ার উদ্দেশ্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা অবৈধ একটি ইটবাহী ট্রলি তাকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ষাটোর্ধ্ব মেম জান। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত হিসেবে ঘোষণা করেন।

শুধু মেম জান-ই নন, ট্রলির মতো অবৈধ ও ভয়াবহ বিভিন্ন যানের কারণে প্রতিনিয়তই প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। শুধু প্রাণহানীই নয়, শহর ও জেলার বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়ানো ইটভাটার মাটি, বালু ও ইট বহনকারী ট্রাক্টর (টলি), মাহেন্দ্রা এবং শ্যালো ইঞ্জিনচালিত অবৈধ যানের কারণে নষ্ট হচ্ছে কোটি-কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কও।

একইসঙ্গে হচ্ছে মারাত্মক শব্দদূষণ। বাতাসে উড়া ধুলাবালুর প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। সাধারণ মানুষের দাবি, প্রশাসনের নাকের ডগাতেই এ ধরনের অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। এতে ক্ষুব্ধ তারা। প্রশাসনের কাছে দ্রুত এসব গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তাদের। আর প্রশাসন বলছে, তারা খবর পেলেই অভিযান পরিচালনা করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনছেন।

রাজশাহী অঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে অবৈধ ও হালকা যানবাহনের চলাচল আগের তুলনায় বেড়েছে। মহাসড়কে এসব যান চলাচল বন্ধ না হওয়ায় প্রতিনিয়তই বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। গত এক বছরে এ অঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৭৫ জন, আহত হয়েছেন ৬০০ জনেরও বেশি।

সড়কে অবৈধ যান ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার অভাব, যানবাহনগুলোর বেপরোয়া গতি, অদক্ষ চালক ও অসচেতনতার কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করেছেন পরিবহন মালিক ও চালকরা। তবে পুলিশ জানিয়েছে, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার ও অবৈধ যান চলাচল বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

হাইওয়ে পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে রাজশাহী জেলা ও মহানগরে ৫৮ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬৮, আহত হয়েছেন প্রায় ২০০ জন। এভাবে নওগাঁয় ৪৭ দুর্ঘটনায় নিহত ৬৫, বগুড়ায় ১১৫ দুর্ঘটনায় নিহত ৯৮, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের মহাসড়কে নিহত ২০০ জন। অধিকাংশ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সড়কে অবৈধ যান, বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিং ও অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচলকে দায়ী করা হচ্ছে।

রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের বাস চালক আমিনুল ইসলাম বলেন, তিনি দীর্ঘদিন থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-ঢাকা রুটে গাড়ি চালান। রাজশাহীর মহাসড়কে চলাচলকারী এসব অবৈধ ছোট বাহনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। এর শব্দ তীব্র হয়। কোনো লুকিং গ্লাসও থাকে না। এতে পেছন থেকে হর্ন দেয়া হলেও তারা বুঝতে পারে না। আবার সড়কের যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যায়। হঠাৎ করে ইউটার্ন নিয়ে বসে। এ সব কারণে দুর্ঘটনা বেশি হয়।

এদিকে, রাজশাহী মহানগরীতে বছরজুড়েই চলে নতুন-নতুন দালান ও অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। এসব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় বালু এবং ইট বহন ও সরবরাহ করা হয় বিভিন্ন অবৈধ যানের মাধ্যমে। বালু সরবরাহের ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে ছয় চাকাবিশিষ্ট ট্রাক ব্যবহার করলেও মানা হয় না সর্বোচ্চ ওজনসীমা।

ফলে শহরের নানা প্রান্তে নির্মিত কোটি-কোটি টাকার সড়ক দেবে-ফেঁটে নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো গ্রামে চলছে নতুন ও পুরাতন পুকুর খনন। সেই খননের মাটি বহন করা হচ্ছে ৬ থেকে ৮ চাকার অবৈধ ট্রাক্টর দিয়ে। আর দিনরাত ট্রাক্টরের চলাচলে নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ জনপদের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোও। চলমান এমন কর্মকাণ্ডে প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা নেই বলে দাবি স্থানীয়দের।

জানা যায়, ২০১২ সালের ১১ জুন মোটরযানের এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র পরিচালনা সংক্রান্ত একটি নীতিমালা অনুমোদন করা হয়, যা ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর রয়েছে। নীতিমালায় মহাসড়কে চালাচলকৃত ছয় চাকাবিশিষ্ট মোটরযানের সর্বোচ্চ ওজনসীমা (যানবাহন ও মালামালসহ) সাময়িক সময়ের জন্য ২২ টন, ১০ চাকাবিশিষ্ট মোটরযানের সর্বোচ্চ ওজনসীমা (যানবাহন ও মালামালসহ) সাময়িক সময়ের জন্য ৩০ টন এবং ১৪ চাকাবিশিষ্ট মোটরযানের সর্বোচ্চ ওজনসীমা (যানবাহন ও মালামালসহ) সাময়িক সময়ের জন্য ৪০ টন নির্ধারণ করা হয়েছে।

এই নীতিমালা না মানলে দুই থেকে ১২ হাজার জরিমানা গুনতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ নীতিমালা মোটেও মানা হচ্ছে না। এছাড়াও সড়ক পাকা হলেই যে কোনো ওজনের যানবাহন সেই সড়কে চলাচলের উপযোগী হয় না। অঞ্চল ভেদে সড়কের যানবাহন ধারণ ক্ষমতা ভিন্ন হয়। গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের তৈরি সড়কের সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা ৮ টন। উপজেলা এলাকায় ১২ টন। জাতীয় মহাসড়কগুলোতে সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা ৪০ টন।

স্থানীয় মহাসড়কে ২২ টন। সড়ক আইনের এ হিসেব কাগজে থাকলেও সড়কে নেই। প্রতিটি সড়কে ধারণক্ষমতায় কয়েকগুণ বেশি ওজনের পন্যবাহী বাহন চলছে হরহামেশা। এসব চলাচলে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই রাস্তাগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে গর্তে পরিণত হচ্ছে।

রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলায় পুকুর খনন ও মাটি পরিবহণের সময় ট্রাক্টর থেকে মাটি পড়ে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সরকারি পাকা সড়ক নষ্ট হয়ে গেছে। এ উপজেলার আরও অনেক সড়ক হুমকির মুখে। উপজেলা এলজিইডি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় মাছ চাষের জন্য ব্যাপকভাবে কৃষি জমিতে পুকুর খনন চলছে।

সরকারি সড়কের ধারে এসব পুকুর খননের কারণে সড়ক ভেঙে যাচ্ছে। আবার পুকুরের মাটি ইটভাটায় ও অন্যত্র ট্রাকের মাধ্যমে পরিবহণের সময় মাটি পড়ে রাস্তার বিটুমিনের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে। উপজেলা প্রকৌশলী খলিলুর রহমান সোনালী সংবাদকে বলেন, ট্রাক্টরযোগে মাটি পরিবহণের কারণে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা রাস্তাগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে।

উপজেলার গণিপুর ইউনিয়ন বিএনপি নেতা সামসুজ্জোহা বাদশা ও কলেজ শিক্ষক আমিনুল ইসলাম জানান, ইটভাটায় ট্রাক্টরযোগে মাটি পরিবহণের কারণে মাদারীগঞ্জ থেকে হাট মচমইল পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার পাকা সড়ক বর্তমানে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম বলেন, কোথাও পুকুর খননের অভিযোগ পেলেই সেখানে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে ভেকু ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে পুকুর খনন বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। তবে কোনো কোনো এলাকায় রাতে আধারে গোপনে পুকুর খননের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

এদিকে রাজশাহীর তানোর উপজেলা পরিষদ গেট থেকে কাশেম বাজার হয়ে মোহনপুর থানার মোড়ে হাইওয়ে সড়কে যুক্ত হওয়া সড়ক জনপদ বিভাগের রাস্তা রয়েছে মাত্র ১২ কিলোমিটার। এই রাস্তারও ধারণ ক্ষমতা সর্বচ্চ ৮টন।

তানোরে অন্য রাস্তা স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক বায়া থেকে কাশেম বাজার মোড়, তানোর থানা মোড় থেকে আমনুরা, তানোর উপজেলার গেট থেকে চৌবাড়িয়া, তালন্দ বাজার মোড় থেকে কলমা বিল্লি হয়ে আইড়ার মোড়সহ বিভিন্ন গ্রামের রাস্তায় হরহামেশাই চলে ২০ টনের পন্যবাহী ট্রাক। তানোর থানা মোড় থেকে লাইসেন্স ও অনুমোদন বিহীন ভুটভুটি অটো গাড়ি চলাচল করছে মুন্ডমালা হয়ে আমনুরা, চৌবাড়িয়া ও বায়াসহ সবগুলো রাস্তায়।

এসব অটো গাড়ী যেখানে ইচ্ছে হরহামেশাই চলাচল করছে। তানোর উপজেলা নির্বাহী অফিসার খাইরুল ইসলাম সোনালী সংবাদকে বলেন, এসব বিষয়ে কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, বিষয়টি গুরুত্বহকারে খোঁজ খবর নিয়ে ধারণ ক্ষমতার বেশি বহনকারী ট্রাক ও পন্যবাহী যানবাহনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি অবৈধ ভুটভুটি ও অটো গাড়ির বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

একই অবস্থা জেলার মোহনপুরেও। এ উপজেলায় হাতে গনা কয়েকজন ব্যক্তি বিভিন্ন এলাকা থেকে অবৈধ ট্রাক্টর ভাড়া করে এনে প্রতিনিয়ত দাপিয়ে চলছে প্রায় প্রতিটি গ্রামীণ রাস্তায়। কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্সের দরকার না হওয়ায় অপ্রাপ্ত বয়স্কদের দিয়েই চলছে ড্রাইভিংসহ পরিচালনার কাজ। কেশরহাট পৌরসভা এলাকার একজন গৃহবধূ জানান, রাস্তার পাশে বাড়ি হওয়ায় সব সময় শিশুদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি। ওরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালায়।

সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপে অবৈধ পুকুর খনন, সড়ক ধ্বংসকারী মাটি বহনে অবৈধ ট্রাক্টর বন্ধ করে এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি এলাকাবাসী ও সচেতন মহলের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন হাইড্রোলিক ট্রাক্টরের মালিক জানান, আমরা প্রতি গাড়ি মাটি দূরত্ব ভেদে দেড় হাজার থেকে তিন হাজার সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করি।

রাস্তার ক্ষতি হলেও তো কোনো উপায় নেই। মোহনপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়শা সিদ্দিকা সোনালী সংবাদকে বলেন, পুকুর খনন বন্ধের জন্য অভিযান প্রতিনিয়ত চালনো হচ্ছে। অবৈধ হাইড্রোলিক টক্টর রাস্তায় চলছে। এগুলো যেহেতু অবৈধ। পুকুর খননকারী ও অবৈধ টক্টর চলাচল বিষয়ে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মোহনপুর উপজেলা প্রকৌশলী নুরনাহার সোনালী সংবাদকে বলেন, সড়কের অবকাঠামো না জেনে অবৈধ ওই গাড়ির মালিকরা তাদের ইচ্ছেমতো মাটি পরিবহণ করছেন। যার করণে সংস্কার বা নির্মাণ করায় বছর শেষ না হতেই সড়কগুলো আগের রূপ ধারণ করছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সার্বিক বিষয়ে রাজশাহীর মোহনপুর জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক (শহর ও যানবাহন) রবিউল ইসলাম সোনালী সংবাদকে বলেন, রাজশাহী-নওগাঁ আঞ্চলিক মহাসড়ককে নিরাপদের যানবাহন চলাচলের জন্য আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। এ রাস্তায় চলাচলকারী সকল অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) নূর আলম সিদ্দিকী সোনালী সংবাদকে বলেন, সড়কে এসব বিষয়ে দায়িত্ব পালন করতে পুলিশের জনবল সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা তো আছেই। মহানগর এলাকায় গভীর রাতে যখন ট্রাফিক পুলিশ সড়কে থাকে না, তখনই মূলত অবৈধ যানের দৌরাত্ম বেশি দেখা যায়। এরপরেও আমরা সজাগ আছি। প্রতিনিয়তই এসব অবৈধ যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। যেখানেই এমন খবর পাওয়া যায়, সেখানেই অভিযান চালিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনা হয়।