চারঘাটে কার্পাস তুলায় কৃষকের মুখে হাসি

কম খরচে মুনাফা বেশি:
মোজাম্মেল হক, চারঘাট থেকে: মাঠ জুড়ে ছোট ছোট গাছের সাদা সাদা ফুল ফাগুনের বাতাসে দোল খাচ্ছে কার্পাস তুলা। কম খরচে মুনাফা বেশি, কার্পাস তুলায় কৃষকের মুখে হাসি। গত বছর ফলন ভালো হয়েছে।
দামও পেয়েছেন কৃষক। তাই এবার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আবাদ হয়েছে কার্পাস তুলা। অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনার এ ‘সাদা সোনা’ চারপাশে ছড়াচ্ছে মনজুড়ানো শুভ্রতা। এর মধ্যে যোগ হয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলের অনুকূল আবহাওয়া, যা রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার তুলা চাষিদের জন্য সোনায় সোহাগা হয়েছে।
ধান-আখসহ অন্যান্য ফসলে অব্যাহত লোকসান ও সেচ সঙ্কটের কারণে উপজেলার কৃষকরা কয়েক বছর ধরে কার্পাস তুলা আবাদে ঝুঁকেছেন। চলতি মৌসুমে ৯৫০ জন কৃষক প্রায় ৩২০ হেক্টর জমিতে এ তুলা আবাদ করেছেন, যা একক উপজেলা হিসেবে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ বলছে রাজশাহী তুলা উন্নয়ন বোর্ড। উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি তুলা চাষ হচ্ছে চারঘাট উপজেলায়।
আমের পর অর্থকরী ফসল হিসেবে তুলা চাষ এ অঞ্চলের চাষিদের কাছে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী সাদা সোনা হিসেবে পরিচিত এ ফসল প্রায় ৭৫টি দেশে চাষ করা হয়। বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম হলেও তুলা আমদানিকারক দেশ হিসেবে দ্বিতীয়।
দেশের পোশাক শিল্পের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ তুলা উৎপাদন বাড়ালে এ খাতে আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব বলে জানিয়েছেন রাজশাহী তুলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোজাদ্দীদ আল শামীম।
সরেজমিন উপজেলার মিয়াপুর, অনুপামপুর, মুংলী, সরদহ ও নিমপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আম বাগান, পেয়ারা বাগান, সবজিখেতসহ বিভিন্ন ফসলের সাথী ফসল হিসেবে তুলা আবাদ হয়েছে। এখন চলছে খেত থেকে তুল্য সংগ্রহের কাজ।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের কৃষক মাসুম, রিপন, সোহেল, শাহাবুল, রশিদুল, আমিরুলের মতো অনেকেই উৎসাহিত হয়েছেন কার্পাস তুলা চাষ করছেন। মিয়াপুর গ্রামের কৃষক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, গত বছর আম বাগানের ছয় বিঘা জমিতে তুলা আবাদ করেছিলেন।
প্রতি বিঘায় ১৪ থেকে ১৫ মণ তুলা পেয়েছেন। খরচ পড়েছিল ১২ হাজার টাকা। চলতি মৌসুমে একই পরিমাণ জমিতে আবাদ করে ৩৫ মণ তুলা সংগ্রহ করেছেন। আরও ৫০ মণ পাবেন বলে আশা করছেন।
মাসুম হোসেন নামের অন্য এক চাষি বলেন, তুলা চাষে লোকসানের সম্ভাবনা খুব কম। তুলা উন্নয়ন বোর্ড থেকে আমাদের কীটনাশক ফ্রি দেয়। গত বছর ভালো লাভ করেছি, এবারও ফলন ভালো হয়েছে।
রাজশাহী তুলা উন্নয়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে উপজেলায় ২৮২ জন কৃষক ৫৮ হেক্টর জমিতে তুলা চাষ করেন। উৎপাদন হয়েছিল ৬ হাজার ৫২৫ মণ।
সরকারি ভাবে প্রতি মণের দাম নির্ধারণ করা হয় ৩ হাজার ৬০০ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৯৪ জন কৃষক ১৭৬ হেক্টর জমিতে আবাদ করে ১৯ হাজার ৮০০ মণ তুলা পেয়েছেন, যা আগের বছরের চেয়ে তিন গুণ বেশি।
চলতি অর্থবছরে কৃষকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫০ জন। আবাদ হয়েছে ৩২০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩৬ হাজার ৫০০ মণ তুলা। এবার সরকারিভাবে দাম নির্ধারণ হয়েছে প্রতি মণ ৪ হাজার টাকা। বাজারমূল্য দাঁড়াবে ১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, যা গতবারের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি।
জেলার ৯ উপজেলায় মোট ৭১৫ হেক্টর জমিতে তুলা চাষ হয়েছে। এর মধ্যে চারঘাটেই হয়েছে ৩২০ হেক্টর জমিতে। চারঘাট তুলা উন্নয়ন বোর্ডের ইউনিটের অফিসার হোসেন আলী বলেন, চলতি মৌসুমে তুলার ফলন ভালো হয়েছে।
চাষিদের দেশি বীজ ও সার কিনতে ঋণ দেয়া হয়েছে। সরকারিভাবে এবার তুলার মূল্য ধরা হয়েছে ৪ হাজার টাকা। আগামীতে তুলা চাষের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি জানান।
পাঁচ বছর ধরে তুলা আবাদ করছেন থানাপাড়া গ্রামের কৃষক মুঞ্জুরুল কাদির। তিনি বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের শুষ্ক মাটিতে ধান চাষে ভোগান্তি পোহাতে হয়। ন্যায্য দাম না পাওয়ায় আখ চাষও কমে গেছে। তুলায় সেচের তেমন একটা প্রয়োজন হয় না।
দেরিতে ফলন হলেও লোকসানের আশঙ্কা থাকে না। সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করে বীজ-সারের দামও পরিশোধ করা যায়। তাই এ ফসলে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের মধ্যে। পদ্মা ও বড়াল নদের তীরে প্রাচীন এ জনপদের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস।
বাঙালির হারানো ঐতিহ্য মসলিন কাপড়ের জন্য মিহি আঁশের কার্পাস তুলা উৎপাদন ও বিক্রির অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল বড়াল নদের চারটি ঘাট সংবলিত চারঘাট উপজেলা। ব্রিটিশের নীল চাষের কাছে তুলার পরাজয় হলেও বর্তমানে এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে তুলা চাষ শুরু হয়েছে।
তুলা চাষ বাড়াতে কাজ করছে এনজিও সংস্থা টিএমএসএস। এর ফিল্ড এক্সিকিউটিভ অফিসার মারুফ আহমেদ জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে এক কেজি বোরো ধান উৎপাদনে পানি লাগে তিন থেকে চার হাজার লিটার, সেখানে ৭০০ থেকে ৮০০ মিলিলিটারে তুলা চাষ সম্ভব। এ কারণে সাথী ফসল হিসেবে এবং উঁচু জমিতে তুলা চাষ বাড়ছে।
স্থানীয়রা বলছে, কার্পাস তুলা চাষের এই অগ্রগতি শুধু কৃষকদেরই আয়ের পথ খুলে দেয়নি, দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। খরচ কম, ঝুঁকি কম এবং নিশ্চিত বাজার থাকায় তুলা চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই জনপদে।