‘ঝরাফুল’ এর জন্য কাঁদছে দেশ

* মাগুরায় জানাজা-দাফন সম্পন্ন
* অভিযুক্তের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ
* দ্রুত বিচারের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার
সোনালী ডেস্ক: মাত্র আট বছরের শিশু সে। বোনের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কটা দিন কাটানোর জন্য বেড়াতে পাঠিয়েছিলেন মা-বাবা। কে জানতো সেই বাড়িতে পাশবিক লালসা নিয়ে ওঁৎ পেতে আছে কেউ। গত ৫ মার্চ রাতে মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালী এলাকায় সেই বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয় শিশুটি।
তার ওপর এতই নির্যাতন চালানো হয় যে, শিশুটির জীবন সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। গুরুতর অবস্থায় তাকে স্থানীয় হাসপাতালের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। পরে নেয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)।
সপ্তাহখানেক মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েও হেরে গেল শিশুটি। যেন না ফুটতেই ঝরে গেল মা-বাবার সাজানো বাগানের ফুল। তাকে হারানোর শোকে শোকার্ত সব-শ্রেণি পেশার মানুষ। মাগুরায় শ্রীপুর উপজেলায় শিশুটির গ্রাম থেকে শুরু করে গোটা বাংলাদেশ যেন শিশুটির জন্য কাঁদছে।
শিশুটির মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, দুপুর ১টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে শিশুটি। এদিন সকালে তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে তার।
দুইবার স্থিতিশীল করা গেলেও তৃতীয়বার আর হৃদস্পন্দন ফিরে আসেনি। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শোকের ছায়া নেমে আসে সর্বত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক-এক্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমে এ নিয়ে শোক প্রকাশ করেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
পাশাপাশি মেয়েটিকে ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতে প্রতিবাদী স্ট্যাটাস দেন অনেকে। শিশুটির মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। শোক জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও। সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা প্রত্যেকে শোকার্ত। শিশুটিকে ধর্ষণ ও হত্যার বিচার আগামীর সাত দিনের মধ্যে শুরু হবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক শোকবার্তায় বলেন, মাগুরার কয়েকটা নরপশুর নিষ্ঠুরতা তার মতো এক শিশুর ওপর দিয়ে গিয়েছিল, আর নিজে কতটা ক্ষতচিহ্ন নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় সংগ্রাম করে জগতের মায়া ছেড়ে আমাদের লজ্জা দিয়ে ও কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে, ভাষায় সেই অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্টে লেখেন, ‘শিশু (…) ইতিহাসের করুণ সাক্ষী হয়ে দেশকে কাঁদিয়ে চলে গেল।
নিজেদের ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তারা বলেন, ‘আমাদের বোন আর নেই। পুরো বাংলাদেশ বোনটির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, লজ্জিত।
স্বজনদের বয়ানে পাশবিকতা এবং মামলা: শিশুটির বাড়ি মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার জারিয়া গ্রামে। আর তার বড় বোনের শ্বশুর বাড়ি মাগুরা সদর নিজনান্দুয়ালি গ্রামে।
স্বজনদের ভাষ্য, গত ১ মার্চ বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে যায় শিশুটি। ৫ মার্চ দিনগত রাত ২টার দিকে শিশুটি তার ভগ্নিপতি সজিব হোসেন (১৯) ও তার বাবা হিটু শেখের (৪৭) হাতে ধর্ষণের শিকার হয়। বড় বোন টের পেয়ে এগিয়ে গেলে তাকে আলাদা রুমে আটকে রাখা হয়। সকালে বড় বোনের শাশুড়ি শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রতিবেশীরা বিষয়টি ফোনকল করে জানায় শিশুটির পরিবারে
। এদিকে খবর পেয়ে পুলিশও ঘটনাস্থলে যায় এবং সজিব ও হিটুকে আটক করে। অন্যদিকে শিশুটিকে প্রথমে মাগুরা ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে সেখান থেকে আনা হয় ঢাকায়। শিশুটির চাচি জানান, বেশ কয়েকদিন আগে শিশুটির বড় বোন বাবার বাড়িতে এসে তার শ্বশুরের দুশ্চরিত্র নিয়ে অভিযোগ করেন এবং শ্বশুরবাড়িতে নিজে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে বলে জানান। চাচি বলেন, আমরা তখন মেয়েটির কথায় বিশ্বাস করতে পারিনি।
একজন শ্বশুর মানে আব্বা। সে কী করে নিজের মেয়ের সঙ্গে (বৌমা) এভাবে খারাপ কাজ করতে পারে! সে কারণে আমরা তাকে বুঝাই সে যেন শ্বশুরবাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই রাজি না হওয়াতে আমরা ওর ছোটবোনকে ওর সাথে পাঠাই। কিন্তু কীভাবে বুঝবো যাকে গার্ড (নিরাপত্তা) দেয়ার জন্য পাঠাইলাম সেই ওই পশুর কুনজরে পড়ে যাবে। আমরা এর বিচার চাই। উপযুক্ত বিচার চাই।
শিশুটিকে ধর্ষণের ঘটনায় গত ৮ মার্চ মাগুরা সদর থানায় চারজনের নামে মামলা করেন তার মা। এতে আসামি করা হয় সজিব শেখ, হিটু শেখ, সজিব শেখের ছোট ভাই রাতুল শেখ (১৭) ও সজিবের মা জাহেদা বেগমকে (৪০)।
এরা চারজনই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। অনেকে বিচারের মাধ্যমে দোষীদের প্রকাশ্য বিচার দাবি করেন। কেউ কেউ বলেন, দীর্ঘ দেড় যুগ দেশে যেভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু ছিল, ধর্ষকরা সে কারণে এই ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিতে পারছে বারবার।
জানাজা ও দাফন: এদিকে শিশুটির মরদেহ ঢাকা থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে মাগুরায় নেয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে হেলিকপ্টারটি মাগুরা স্টেডিয়ামে পৌঁছায়।
পরে শহরের নোমানী ময়দানে শিশুটির জানাজার নামাজ সম্পন্ন হয়। তার মরদেহ গ্রামে নিয়ে দাফন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে রাজধানী থেকে শিশুটির মাসহ পরিবারের সঙ্গে মাগুরায় গেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলমসহ অনেকে।
অভিযুক্তের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ: আট বছরের শিশুটি মাগুরা সদর উপজেলার যে বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল সেই বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন দিয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে উপজেলার নিজনান্দুয়ালী গ্রামের হিটু মিয়ার বাড়িতে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা ওই বাড়িতে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে জানান ঘটনাস্থলে থাকা ওই গ্রামেরই বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম। এদিকে ধর্ষণের ঘটনার দ্রুত বিচারের দাবিতে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ বিক্ষোভ করছে স্থানীয় জনতা। রাত ৮টার দিকে তারা মাগুরা শহরের ভায়না মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। এতে সড়কের উভয় পাশে যানজটের সৃষ্টি হয়।