রাজশাহীতে সহস্রাধিক ধর্ষণ মামলা বিচারাধীন

মাইনুল হাসান: রাজশাহী নগরীর কাশিয়াডাঙা থানায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ২০২২ সালে মামলা হয়। ওই মামলার বাদীর অভিযোগ, শুরুতে থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। শুরু থেকেই তদন্ত প্রক্রিয়া চলতে থাকে ধীর গতিতে। পরে তদন্ত কর্মকর্তার আচরণ রহস্যজনক মনে হলে তিনি আদালতে তদন্তকারী সংস্থা পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেন। এতে তদন্তের দায়িত্ব পান পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
বাদী জানান, তদন্ত শেষে দুজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশীট জমা দেয় পিবিআই। চার্জশীটে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার ৮ মাস পর ডিএনএ পরীক্ষা করায় ভুক্তভোগী ছাত্রীর সাথে ধর্ষণ প্রমানিত হয়েছে কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় ওই ছাত্রীর জামা, ওড়না ও পায়জামা পরীক্ষা করে আসামিদের ডিএনএ পাওয়া যায়নি। আলমত নিয়ে গড়িমসি করায় এখন বিচার নিয়ে শঙ্কায় ওই ছাত্রীর অভিভাবকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে রাজশাহীতে অন্তত সহস্রাধিক ধর্ষণ মামলা বিচারাধীন । সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, এ সংক্রান্ত মামলার বিচার চলছে ধীরগতিতে। এর অন্যতম কারণ ডিএনএ এবং ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন সহজে না পাওয়া। দ্রুত প্রতিবেদন না মেলায় তদন্ত শেষ করলেও আদালতে চার্জশিট দাখিল করতে পারছেন না পুলিশ অথবা তদন্তকারী সংস্থা। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রতিবেদন নিয়ে জটিলতা, বাদী–বিবাদীর আপস, মিমাংসা, সাক্ষী গরহাজিরসহ নানা কারণে পার পেয়ে যাচ্ছেন আসামিরা।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০–এর অধীনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড এবং ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে তৎকালীন সরকার। এরপর থেকে গেল ৫ বছরে রাজশাহী বিভাগীয় স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরির মাধ্যমে ১ হাজার ২৫৮টি ধর্ষণ মামলার নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয় ঢাকায়। ঢাকার ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে (এনএফডিপিএল) নমুনা পরীক্ষা হয়।
সারাদেশের নমুনা একটি স্থানে পরীক্ষাসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জট।
ব্লাস্ট এর রাজশাহী জেলার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট সামিনা বেগম বলেন, ধর্ষণের মামলাগুলো দীর্ঘায়িত হওয়ার অন্যতম কারণ ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন সহজে না পাওয়া। এছাড়াও বাদী–আসামিপক্ষের আপোস মীমাংসা, বিচারের ধীরগতি, তদন্তে গাফিলতি, মিথ্যা সাক্ষ্য, সাক্ষীর গর হাজিরসহ নানা কারণে আসামিরা খালাস পাচ্ছেন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালে ২৫৬টি ধর্ষণ মামলা, ২০২১ সালে ২৩০টি ধর্ষণ মামলা, ২০২২ সালে ২৭২টি ধর্ষণ মামলা, ২০২৩ সালে ২০৫টি ধর্ষণ মামলা, ২০২৪ সালে ২৬১টি ধর্ষণ মামলা ও ২০২৫ সালে ৩৪টি ধর্ষণ মামলার নমুনা ডিএনএ টেস্টের জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. শংকর কে বিশ্বাস বলেন, বিভাগীয় স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরিতে শুধুমাত্র নমুনা সংগ্রহ করা হয়। একমাত্র ঢাকায় প্রোফাইলিং হয়। অন্যদিকে ধর্ষণের একটি মামলাতেই নমুনা থাকে অনেকগুলো। ভুক্তভোগীর পোশাক, ঘটনাস্থলের যেকোনো জিনিস ইত্যাদি। নমুনা বেশি হওয়ায় পরীক্ষায় বেশি সময় লাগে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পেতে এক বছর থেকে দেড় বছর পর্যন্ত কখনও কখনও অপেক্ষা করতে হয়। অন্যদিকে মামলার আলামত সঠিকভাবে সংরক্ষন না করা, দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা ও ডিএনএ প্রতিবেদন না পাওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আটকে থাকছে তদন্ত। তদন্ত স্থবির হয়ে থাকায় নষ্ট হচ্ছে আলামত, দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিচ্ছে আসামিরা।
রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল–১ এর পিপি অ্যাডভোকেট শামসাদ বেগম মিতালী বলেন, ধর্ষণের মামলাগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করলে দ্রুত বিচার পক্রিয়া শেষ হবে। ডিএনএ এবং ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন দ্রুত দেয়ার জন্য সরকারের বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
একাধিক সুত্র জানিয়েছে, রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ১ ও ২ এ বর্তমানে অন্তত সাড়ে ৩ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এরমধ্যে অর্ধেকই ধর্ষনের মামলা।