১৮০ নয়, ৩০ দিনের মধ্যে ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে উত্তাল রাজশাহী

স্টাফ রিপোর্টার: মাগুরায় আট বছরের শিশুসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো মহানগরী। ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়।
ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে গত শনিবার মধ্যরাত থেকেই শুরু হয় শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলন। সড়কে নেমে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। রাবি থেকে সেই বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে মহানগরীতেও। গতকাল সোমবার দুপুর সোয়া ১২টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত রাবির প্রধান ফটকের সামনে কর্মসূচি পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে সরকার কর্তৃক ধর্ষণের বিচারের জন্য ১৮০ দিনের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে ৩০ দিনের মধ্যে ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি গতকাল ধর্ষণের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে (রাবি) শাখা ছাত্রদলও। অপরদিকে গতকাল বেলা ১১টায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী মহানগর শাখার উদ্যোগে ধর্ষণবিরোধী মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিতকরণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ জানান শিবিরের নেতারা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, ৩০ দিনের মধ্যে ধর্ষকের বিচার শেষ করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সোমবার দুপুর সোয়া ১২ টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে এ কর্মসূচি পালন করেন তারা। এতে সড়কটির দুইপাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে।
অবরোধ তুলে নেয়ার পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। একই দাবিতে আজ মঙ্গলবার ফেসবুকে চোখে-মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রোফাইল ফটো আপলোড করে প্রতিবাদ জানানোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা প্যারিস রোডে জড়ো হতে থাকেন। সেখানে অবস্থান নিয়ে তাঁরা ধর্ষণবিরোধী নানা স্লোগান দেন। পরে দুপুর ১২টার কিছুক্ষণ পর শিক্ষার্থীরা একটি মিছিল নিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করেন।
দুপুর সাড়ে ১২টায় নগরীর তালাইমারী এলাকা থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে একটি মিছিল এতে সংহতি জানায়। দুপুর ১টায় আগামীকালকের কর্মসূচি ঘোষণা করে তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। বিক্ষোভে শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে? আমি কে? আছিয়া আছিয়া’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, ধর্ষকদের কবর দে’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, নো মোর র্যাপিস্ট’, ‘আমার বোনের কান্না, আর না আর না’, ‘একটা একটা ধর্ষক ধর, ধরে ধরে জবাই কর’, ‘খুনি কেন বাহিরে, ইন্টেরিয়ম জবাব চাই’, ‘বিচার বিচার চাই, ধর্ষকের বিচার চাই’, ‘রশি লাগলে রশি নে, ধর্ষকদের ফাঁসি দে’ ‘ধর্ষকের শাস্তি, মৃত্যু মৃত্যু’ প্রভৃতি স্লোগান ও প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
কর্মসূচিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, আমাদের দাবি যত দ্রুত সম্ভব বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করতে হবে। আছিয়া, তনু, খাদিজা থেকে শুরু করে যতগুলো ধর্ষণকাণ্ড হয়েছে সব ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সেই সঙ্গে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত করে ৩০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য শেষ করতে হবে এই মর্মে আইন পাস করতে হবে। শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াসিন আরাফাত বিজয় বলেন, সারা বাংলায় ধর্ষকের একটি চক্র তীব্রভাবে জেগে উঠেছে।
আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছি। অন্তর্বর্তী সরকার ধর্ষণের বিচারের জন্য ১৮০ দিনের যে ঘোষণা দিয়েছে, তা আমরা ঘৃণ্যভাবে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা চাই দ্রুত সময়ে বিচার কার্য শেষ হোক। এ সময় যেন এক মাসের বেশি না হয়। আজ মঙ্গলবারের কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার রক্তের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে টালবাহানা করার জন্য চেয়ারে বসানো হয়নি।
আপনারা যদি চেয়ারের মর্যাদা রক্ষা করতে না পারেন, তাহলে অতি শীঘ্রই নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। ধর্ষকদের কোনো ভাবেই এই বাংলায় জায়গা দেয়া হবে না।
১৮০ দিন নয়, ৩০ দিনের মধ্যে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই দাবিতে আমরা আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চোখে মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রোফাইল ফটো আপলোড করবো।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিদবেদক আরও জানান, দেশব্যাপী নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, নিপীড়ন, ধর্ষণ, অনলাইনে হেনস্তা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি ও বিচারহীনতার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রদলও। গতকাল সোমবার দুপুর ১২ টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্যারিস রোডে মানববন্ধনটি পালন করা হয়। এ সময়, ‘ধর্ষকরা নিপাত যাক, নারী সমাজ মুক্তি পাক’, ‘ধর্ষকদের ঠিকানা এই বাংলায় হবে না’, ‘ধর্ষণকারী নরপিশাচ, আমরা করব তার বিনাশ’, ‘বোন তোমার ভয় নাই রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘তুমি কে আমি কে, আছিয়া আছিয়া’, ‘হয় ধর্ষকের ফাঁসি দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’ ব্যানারের মাধ্যমে এসব স্লোগান তুলে ধরেন তারা। মানবন্ধনে নাট্যকলা বিভাগের জাহিন বিশ্বাস বলেন, আজকে যে দাবি নিয়ে আমরা হাজির হয়েছি এটা শুধু ছাত্রদলের আন্দোলন না, সাধারণ জনগণ এবং প্রতিটা মেয়ের দাবি হলো এটি।
আমাদের মেয়েদের রাতে বের হতে যদি এখনো ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় তাহলে কিসের জন্য এই জুলাই বিপ্লব। এই বিপ্লবের পরেও কেন ধর্ষকদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমারা যখন কোনো কর্মসূচি করতে আসি তখন সাইবার বুলিং আমার কেম্পাসের ভাইরা করে। আমি তাদের থেকে আমার নিরাপত্তা আশা করি সাইবার বুলিং না। আমাদের বোন আছিয়া সে তো এখনো পুরোপুরি নারীও হয় নি সে হলো শিশু তাকে কেন ধর্ষণের শিকার হতে হলো। আমাদের অন্তর্বতী সরকার এখনো কেন সুষ্ঠু বিচার করতে পারলো না। এভাবে ধর্ষকরা পার পেয়ে গেলে তারা আরও হিংস্র হয়ে যাবে।
এসময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক আমানউল্লাহ আমান বলেন, ফ্যাসিস্ট শাসনামল ও বর্তমান শাসনামলের বিচার ব্যবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি না। পার্থক্য শুধু একটি জায়গায় আগে হাসিনা শুধু মুজিব পরিবারের কথা বলতো আর এখন দূর্ভিসন্ধিমূলক কথাবার্তা বলে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা চলছে। জুলাই আগস্টে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলো দেশে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য।
কিন্তু আমরা তার বিপরীত চিত্র দেখতে পারছি। কাউকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য মানুষ রক্ত দেয়নি। দেশে বিচার ব্যবস্থা শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না আনতে পারলে বর্তমান সরকারের অবস্থা শেখ হাসিনার থেকেও ভয়াবহ হবে। তিনি আরও বলেন, আছিয়ার ঘটনা মিডিয়াতে এসেছে তাই আমরা তার প্রতিবাদ করছি। কিন্তু এইরকম শত শত আছিয়া প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনুরোধ করব ধর্ষকদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য যাতে আর কোনো কুলাঙ্গার ধর্ষণ করার সাহস না পায়।
এদিকে গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে ধর্ষণবিরোধী মানববন্ধনের আয়োজন করে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী মহানগর শাখা। কর্মসূচি থেকে যারা ধর্ষিতা তাদের জানাজার আগে যদি ধর্ষকের জন্য এ ব্যবস্থা করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে আর কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হবেন না বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি শামীম উদ্দিন। নগর ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি ইমরান নাজিরের সঞ্চালনায় মহানগর জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক জসিমউদ্দিন সরকার, রাজশাহী কলেজ শিবিরের সভাপতি মাহমুদুল হাসান মাসুম প্রমুখ বক্তব্য দেন।
বক্তারা বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ১৬ বছরে ধর্ষণের সেঞ্চুরি হয়েছে, তাদের পতন হলেও বর্তমান সরকারের ৭ মাস পার হলেও আইন-শৃঙ্খলা অবনতির কারণে আগের ধারাবাহিকতায় এখনো ধর্ষণ, ডাকাতি, ছিনতাই চলমান রয়েছে। মাগুরায় ৮ বছরের শিশু আছিয়া ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ ছাত্রশিবির রাজপথে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।
এছাড়াও সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ধর্ষণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সব অপরাধীকে অতিশিগগিরই গ্রেপ্তার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার দাবিও জানান তারা। নগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি শামীম উদ্দিন বলেন, আমরা লজ্জিত আট বছরের শিশুকে এভাবে ধর্ষণ করে। সরকারি তথ্য মোতাবেক ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৬ হাজার ৬৯৫টি। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বাংলাদেশে শতকরা ৯৫ ভাগ মুসলমানের দেশ হয়েও ধর্ষণের সেঞ্চুরির পর মিষ্টি বিতরণ করেছে।
অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশে যদি প্রকাশ্যে কংকর নিক্ষেপ করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় তাহলে আর কেউ এ কাজ করার সাহস পাবে না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এমন একটি সমাজ চায়, যেখানে গভীর রাতে নারীরা হেঁটে যাবে কিন্তু তাদের ধর্ষণের কোনো ভয় থাকবে না। বাংলাদেশে রাতে চলাচলে জন্য কোনো ভয়-ভীতি, চিন্তা থাকবে না। সবাই নির্দ্বিধায় চলাচল করবে। শুধু আট বছরের এই শিশুর ঘটনায় সীমাবদ্ধ না থেকে এর বাইরে যত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে প্রত্যেকটির সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। মানববন্ধনে রাজশাহী মহানগর ছাত্রশিবিরের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।