ঝিনাইদহের গৌরব বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম পাচ্ছেন মরোণত্তর ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’

অনলাইন ডেস্ক: জেলার কীর্তিমান সন্তান বিজ্ঞানী ও গবেষক অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম এ বছর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এর জন্য মনোনীত হয়েছেন। বিশ্বখ্যাত গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও পদার্থবিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের এই অর্জনে জেলা জুড়ে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৫ সালে ঘোষিত স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকায় মহান এই গবেষকের নাম থাকায় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন জেলার সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সুধীজনেরা।
জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এ বছর আট বিশিষ্টজনকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। ২০২৫ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত বিশিষ্টজনদের মধ্যে আছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী, বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর, কবি আল মাহমুদ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অন্যতম নকশাকার নভেরা আহমেদ, পপসম্রাট আজম খান ও আবরার ফাহাদ। আবরার ফাহাদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০১৯ সালের অক্টোবরে বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নির্যাতনে তিনি নিহত হন।
জামাল নজরুল ইসলাম–এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
পদার্থবিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বৃটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের ঝিনাইদহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম ও মা রাহাত আরা বেগম। তাঁর সহধর্মিণীর নাম ড. সুরাইয়া ইসলাম। ড. জামাল নজরুল ইসলাম ও ড. সুরাইয়া ইসলাম দম্পতির দুই কন্যা সন্তান রয়েছে।
তাঁর বাবা ছিলেন ঝিনাইদহের তৎকালীন মুন্সেফ। জামাল নজরুল ইসলামের বয়স যখন ১ বছর তখন চাকরির সুবাদে তার বাবা কলকাতায় বদলি হন। সেখানে তিনি প্রথমে কলকাতার মডেল স্কুল ও শিশু বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা শুরু করেন। কলকাতায় মডেল স্কুলে পড়াশোনা শেষে তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবে গিয়ে ভর্তি হন লরেন্স কলেজে। ওই কলেজ থেকেই তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি অনার্স সম্পন্ন করেন।
ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে ১৯৫৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৯৬০ সালে কেমব্রিজ থেকে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি ও ১৯৮২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসসিডি (ডক্টর অফ সায়েন্স) ডিগ্রি অর্জন করেন।
২০১৩ সালের ১৬ মার্চ ৭৪ বছর বয়সে চট্টগ্রামে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চট্টগ্রামের গরীবুল্লাহ শাহ মাজার কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
জামাল নজরুল ইসলামের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন
জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল ফেলো ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজ ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে গবেষণা করেছেন। ১৯৭১-৭২ দুই বছর ক্যালটেক বা ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ১৯৭৩-৭৪ সালে লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের শিক্ষক, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সিটি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেন।
জামাল নজরুল ইসলামের অনেক গবেষণা নিবন্ধ বিখ্যাত সব বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স’ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বের কসমোলজিস্টদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। বইটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। পরের বছর কেমব্রিজ থেকেই প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি’ নামক আরেকটি বই। তাঁর গবেষণা আইনস্টাইন-পরবর্তী মহাবিশ্ব গবেষণায় বিরাট অবদান রেখেছে। তিনি এই ধারায় গবেষণা অব্যাহত রেখে পরবর্তীকালে লেখেন ‘ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স’ বা ‘মহাবিশ্বের দূরবর্তী ভবিষ্যৎ’।
১৯৮৪ সালে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম প্রবাসের উন্নত জীবন, সম্মানজনক পদ, গবেষণার অনুকূল পরিবেশ, বিশ্বমানের গুণীজন সাহচর্য এবং আর্থিকভাবে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। স্থায়ী হন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে যোগ দেন মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে। এর আগে তিনি একাধারে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ড, কলেজ পার্ক, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন, ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি, সিটি ইউনিভার্সিটি লন্ডন, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সের গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একজন সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্ঠা পর্ষদেরও সদস্য ছিলেন তিনি। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘উচ্চতর গবেষণা সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন (বাছাই) কমিটির সম্মানিত চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
সৃষ্টিকর্ম
জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন মূলত তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল আপেক্ষিকতা, বিশ্বতত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব। তিনি ৫০টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ এবং বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে; ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’, ‘ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি’, ‘রোটেটিং ফিল্ড্স ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’, ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি’, ‘কৃষ্ণ বিবর’, ‘স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ’ এবং ‘দ্য ফার ফিউচার অফ দি ইউনিভার্স’। এ ছাড়া তিনি ‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা’ নামে একটি বাংলা ভাষার গবেষণা গ্রন্থও রচনা করেন।
পুরস্কার
১৯৮৫ সালে তিনি ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি স্বর্ণপদক’, ১৯৯৪ সালে ‘ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মেডেল’, ১৯৯৮ সালে ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর থিওরিটিকাল ফিজিক্সে ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সের মেডাল লেকচার পদক’, ২০০০ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এ বছর তিনি সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ (মরণোত্তর)-এর জন্য মনোনীত হয়েছেন।
সূত্র: বাসস