ভাড়া মারতে গিয়ে আসামি হলেন ভ্যান চালক

বদলগাছী (নওগাঁ) প্রতিনিধি: নওগাঁর বদলগাছীতে ওএমএসের চাল কালো বাজারে বিক্রির উদ্দেশে পাচারের ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে- মূল হোতাদের বাদ দিয়ে নিরীহ ভ্যান চালকের নামে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ডিলারকেও।
মামলাটি করেছেন- উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা সাবরিন মোস্তারী। অভিযোগ আছে; মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে এ ঘটনার পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ানো মূলহোতাদের। এমন ঘটনায় উপজেলা জুড়ে চলছে সমালোচনার ঝড়।
জানা যায়, গত ৩ মার্চ সকালে ওএমএসের চাল কালোবাজারে বিক্রির উদ্দেশে পরিবহন করার সময় এক ভ্যান চালসহ ভ্যানের চালককে আটক করা হয়। সেই সাথে গত ২ মার্চ ওএমএসএর চাল এক বাড়িতে মজুদ রাখার দায়ে আরও এক নারীকে আটক করা হয়।
এসময় তাদের কাছ থেকে মোট ৮শ ৩২ কেজি চাল জব্দ করে উপজেলা প্রশাসন। স্থানীয়রা জানান, গত সোমবার সকালে অছির উদ্দিন নামে এক ভ্যান চালক খাদ্য গুদাম থেকে ৩০ কেজি ওজনের ১৫টি বস্তা (৪৫০কেজি) ওএমএসের চাল নিয়ে সাহেব বাজার ডিলার পয়েন্টের দিকে রওনা হন। কিন্তু সেখানে না গিয়ে তিনি ইসমাইলের বাড়িতে চালের ভ্যান নিয়ে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার সময় ওই চালসহ ভ্যান চালককে আটক করা হয়।
এছাড়া ভ্যান চালকের তথ্য মতে বদলগাছী সদর ইউনিয়নের জিধিরপুর গ্রামের ইসমাইলের বাড়ি থেকে আরও ৩৮২ কেজি চাল জব্দ করা হয়। সেই সাথে ইসমাইলের স্ত্রী বিজলি বেগমকে আটক করে উপজেলা প্রশাসন।
আনোয়ার হোসেন টগর নামের এক ডিলারের নামে বরাদ্দকৃত উঠানো চালগুলো প্রতিদিন ৩০ টাকা কেজি দরে দুস্থ ও গরীব মানুষের মাঝে বিক্রি করার কথা থাকলেও বেশি লাভের আশায় কালোবাজারে চাল বিক্রি করে দিচ্ছিলেন পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ানো ব্যক্তি। ৫০০ টাকায় দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা ইউসুফ জানান, আনোয়ার হোসেন টগরের নামে ডিলার থাকলেও হাসানুজ্জামান এর মূলহোতা। কারণ দিনশেষে চাল বিক্রির সকল হিসাব তাকে দিতে হতো।
তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে জানি না, হাসানুজ্জামান বলতে পারবে। কারণ সে এই ডিলার দেখাশুনা করে। তবে আনোয়ার হোসেন টগরের ডিলার হাসানুজ্জামান কেন দেখাশুনা করবে এমন প্রশ্নে তেমন কোনো উত্তর দিতে পারেনি ইউসুফ। ডিলার আনোয়ার হোসেন টগর বলেন, আমি শুধু নামে ডিলার।
সব কাজ করেন হাসানুজ্জামান। তিনিই মূলহোতা। আমি আওয়ামী লীগ করি তাই খোলা বাজারে চাল বিক্রির আগে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আমাকে তার অফিসে ডেকে হুমকি দিয়ে বলেন, আপনারতো ডিলারি থাকবে না।
আমি অনেক চেষ্টা করে আপনাকে রাখার ব্যবস্থা করছি, তাই আমি যা বলবো সেটা আপনাকে করতে হবে- এমন কথা বলে হাসানুজ্জামানকে ডিলার পয়েন্ট চালানোর জন্য আমার কাছ থেকে একটি কাগজে লিখিত নেন এবং সেই অনুযায়ী শুরুতেই ১/২ দিন হাসানুজ্জামান তার নিজ ঘরেই চাল বিতরণ করেন।
পরে হাসানুজ্জামানের নামে অভিযোগ হলে আবারো খাদ্য নিয়ন্ত্রক আমাকে অফিসে ডেকে ইউসুফ আলী নামের একজনের জন্য লিখিত নেন আমি তাকে চিনিও না। সেই লিখিত নিয়ে হাসানুজ্জামানের ঘরের উত্তর সাইর্টের একটি ঘরে চাল বিতরণ করছেন ইউসুফ এর নামে হাসানুজ্জামান। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা সাবরিন মোস্তারী এই সকল অনিয়মের সাথে জড়িত।
তিনি আরও বলেন, আমি কালোবাজারে চাল বিক্রির বিষয়ে কিছু জানি না। আমার কাছ থেকে শুধু ডিওতে স্বাক্ষর নেন। আমার নামে ব্যাংকে ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে টাকাও জমা করেন হাসানুজ্জামান। এর বেশি কিছু আমি জানি না। ইউসুফ বিষয়টি ভালো বলতে পারবে।
আজ বিনা অপরাধে আমি আসামি হলাম। জানতে চাইলে ভ্যান চালক অছির উদ্দিন বলেন, গোডাউনের সরদার সাইদুর আমাকে চালগুলো সেখানে দিয়ে আসতে বলেছে। তাই নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাকে শুধু ১শ টাকা করে ভাড়া দেয়। একশ টাকার ভাড়া মারতে গিয়ে এখন আসামি হলাম। আমি গরীব মানুষ, টাকার জন্য ভাড়া মারছিলাম।
বদলগাছী সরকারি খাদ্য গুদামের লেবার সরদার সাইদুর বলেন, আমাকে সাংবাদিক হাসানুজ্জামান বলেছিলো চালগুলো একটি ভ্যানে করে জিধিরপুরে পৌঁছে দিতে। আমরা লেবারের কাজ করি সব সময় খাদ্য গুদামে কাজ না থাকায় আমরা কয়েকজন লেবার অবসর সময়ে ভ্যান চালাই।
তাই আমার এক লেবারের ভ্যানে চালগুলো পাঠিয়েছি। আমরা গরীব মানুষ পড়াশুনা জানি না, আমি কি ভাবে বুঝবো এসব। এ বিষয়ে হাসানুজ্জামান মুঠোফোনে গণমাধ্যমকর্মীকে বলেন, ফুডে কিছু হলে আমার ওপর দোষ আসে। তবে কি কারণে দোষ আসে, আমি সঠিক জানি না।
আনোয়ার হোসেন টগরের ডিলার আপনি কেনো দেখাশুনা করেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আমি জানি না। এগুলো তারা মিথ্যা বলছে। ট্যাগ অফিসার শাহরিয়া দায়সারা ভাবে বলেন, আমি সকালে ডিলারের ঘরে এসে ৩২ বস্তা চাল পেয়েছি। আর ১৮টি খালি বস্তা পেয়েছি।
খাদ্য গুদাম থেকে ডিলারের ঘরে আর কোনো চালের বস্তা আসেনি। পথিমধ্যে চাল কি হয়েছে আমি কিছু বলতে পারবোনা।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা সাবরিন মোস্তারী বলেন, ডিলার আনোয়ার হোসেন টগর, ভ্যান চালক অছির, ইউসুফ আলী, বিজলি ও তার স্বামীর নামে মামলা করা হয়েছে। হাসানুজ্জামান, ট্যাগ কর্মকর্তা শাহরিয়ার নামে মামলা হলো না কেন বলে প্রশ্ন করলে তিনি কোন উত্তর দেননি।
নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন মুঠোফোনে বলেন, অন্য কাউকে অথরিটি দিয়ে চাল বিক্রির নিয়ম আছে। আর উপজেলা কমিটি আছে তারাই বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন। তবে খাদ্যের কোনো কর্মকর্তা এর সাথে জড়িত থাকলে, অভিযোগ সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে মামলা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বদলগাছী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহজাহান আলী। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও খাদ্যবান্ধব কমিটির সভাপতি ইসরাত জাহান ছনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে মামলা করা হয়েছে। ভ্যানচালক বিষয়টি আগে থেকেই জানতো।
বিজলির বাড়িতে চাল পাওয়ায় তাকে ও তার স্বামীকে আসামি করা হয়েছে। আর সর্বশেষ অথরিটি হিসেবে ইউসুফের নাম আসায় তাকেও আসামি করা হয়েছে। বিজলির স্বামী ইসমাইলকে জড়িত করা হলেও হাসানুজ্জামানকে কেন জড়ানো হলো না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাসানুজ্জামানের নামটা ওভাবে কেউ বলেনি। তারপরও বিষয়টি পুলিশ তদন্ত করে দেখবে। এছাড়া যদি কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।