নারায়ণগঞ্জের দলিত সম্প্রদায়ের সনু হয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা

অনলাইন ডেস্ক: জেলার সুইপার কলোনির দলিত সম্প্রদায়ের প্রথম গ্রাজুয়েট সনু রানী দাস, পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার। তবে তার এ পর্যায়ে আসার গল্পটা খুব সহজ ছিল না। স্বপ্ন, ছোট্ট এ শব্দে যেন হাজারো আকাঙ্ক্ষা মিশে আছে। স্বপ্নের সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাকে করতে হয় কঠিন থেকে কঠিন পরিশ্রম।
আজ সনু রানী এক সংগ্রামী সফল মানুষ। নিজ সম্প্রদায়ের গণ্ডি পেরিয়ে দেখেছিলেন ছোট্ট একটি স্বপ্ন। চেয়েছিলেন নিজে শিক্ষিত হয়ে সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি তার। শিক্ষক হতে পারেনি সনু। তবে দমে যাননি তিনি। স্বপ্ন দেখছেন, নিজের সম্প্রদায়ের জীবনমানের উন্নয়নে। সেই স্বপ্ন থেকেই নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছেন বেসরকারি সংগঠন ‘দলিত নারী উন্নয়ন সংস্থা’। জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হয়েছেন সনু রানী দাস।
নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের সুইপার কলোনির ছোট্ট একটি ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সনু রানী দাস (৩৪)। কলোনির সেই ছোট্ট গণ্ডিতেই তার বেড়ে ওঠা। তবে তার স্বপ্ন ছোট ছিল না। নিজ গণ্ডি পেরিয়ে হয়েছেন জেলার দলিত সম্প্রদায়ের প্রথম গ্রাজুয়েট। বর্তমানে তিনি সদর উপেজেলার পাইকপাড়ার ঋষিপাড়া এলাকায় অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
নিজের ইচ্ছাশক্তি ও মনোবলেই সমাজে বাধা ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে পারা যায় এবং নারী-পুরুষ কিংবা যেকোনো বৈষম্যের উচ্চকণ্ঠে কথা বললে অধিকার আদায় করা সম্ভব বলে মনে করেন সনু রানী। তবে, দলিত সম্প্রদায়ের বাধাবিপত্তি পেরিয়ে শিক্ষা অর্জন করেও তার মুখে নিরাশার হাসি আর আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস। সম্প্রতি তার সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে তার নেপথ্যের কারণ।
সনু রানী বলেন, আমাদের দলিত সম্প্রদায় একটা শিশু প্রাইমারি পাস করলে সেটাকেই অনেক মনে করা হতো। এর বেশি পড়াটা অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা বলে মনে হতো।
আর মেয়েরা পড়ালেখা করলে তো মেয়ে খারাপ দিকে চলে যাবে বলে এ সম্প্রদায়ের মানুষের ধারণা ছিল। সেই পরিবেশে থেকে অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে স্নাতক পাস করি।
সেই সময়ই এ সম্প্রদায় মানুষের চিন্তা ভাবনা পরিবর্তনের একটি ইচ্ছা জাগে। তাদের মন মানসিকতা পরিবর্তনের অন্যতম উপায় হলো, শিক্ষা। তখন মনে হয় শিক্ষিত করতে হলে প্রথমে আমাকে শিক্ষিত হতে হবে।
দলিত সম্প্রদায়ের ১৬৪টি পরিবারের এ কলোনিতে ১৯৬৪ সাল থেকেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। তবু ২০০৬ সালের আগে সেই কলোনির কেউ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করতে পারেননি। সনু এবং তাঁর দুই বান্ধবী মিনা ও পূজা নারায়ণগঞ্জের হরিজনদের মধ্যে প্রথম এসএসসি পাস করেন। ২০০৬ সালে এসএসসি এবং ২০০৮ সালে এইচএসসি পাস করেন সনু রানী। এরপর স্নাতক শেষ করে মাস্টার্স এর প্রিলি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।
সনুর মতে, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, পরিবারগুলোর অসচেতনতা ও অর্থনৈতিক দৈন্যই এর জন্য দায়ী। সুইপারদের মাতৃভাষা হিন্দি হলেও পাঠ্যবইগুলো বাংলায়। বাংলা বুঝতে না পারায় প্রাথমিক পর্যায়েই ছেলেমেয়েরা ঝরে পড়ে। স্কুলের শিক্ষকেরা ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন সংস্কৃতির হওয়ার কারণে পড়াশোনাটা শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে না। সরকারি স্কুলে শিক্ষক হওয়ার জন্য দিয়েছেন সনু রানী দিয়েছেন একাধিক পরীক্ষা।
কিন্তু কোথাও চাকরি না হওয়ায় বেশ অনেকদিন হতাশায় কেটেছে তার দিন। হতাশা কাটিয়ে আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছেন সনু। নিজ সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে শুরু করেছেন সমাজসেবামূলক বেসরকারি সংস্থা।
সনু রানি বলেন, ‘অনেক চেষ্টার পরেও যখন শিক্ষক হতে পারলাম না, তখন অনেকটা হতাশ হয়েছিলাম। পরে ভাবলাম, আমি পারিনি তো কি হয়েছে আমি সেই ঢাল হবো, যা আমার মত অন্যান্যদের স্বপ্নপূরণে সহযোগিতা করবে। দলিত নারী ফোরাম নামক সংগঠনে প্রোগাম অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করলাম।
বাংলাদেশে দলিত নারীদের অধিকার রক্ষা আন্দোলনের জাতীয় প্লাটফর্ম ‘বাংলাদেশ দলিত এক্সপ্লোডেড রাইট মুভমেন্ট (ডিডিইআরএম)’ এরই একটি শাখা দলিত নারী ফোরাম। এখানে কাজ করে আমি অনেক কিছু শিখেছি, জেনেছি। কিন্তু আমার সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য কিছু করতে পারিনি। তাই সেখানের চাকরি ছেড়ে আমার সম্প্রদায়ের নারীদের উন্নয়নে সংগঠন করেছি।
সনু জানান, উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়েই পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি কাজ করেছেন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সঙ্গে। সেখান থেকে সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে স্কটল্যান্ডের গ্লোবাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশ নেন । এরপর তিনি হিউম্যান রাইটসের এক সম্মেলনে অংশ নিতে জেনেভায় গিয়েছিলেন ।
গত বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক একটি সংগঠনের অন্তর্ভুক্তি প্রকল্পের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সেমিনারে তিনি অংশগ্রহণ করেন। তার কাজের প্রশংসার পাশাপাশি পেয়েছেন একাধিক সম্মাননা। ২০২৩ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক নারী দিবসে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হয়েছেন সনু রানী দাস। সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী ক্যাটাগরিতে তিনি এ সম্মাননা লাভ করেন।
সনু রানীর স্বামী গৌতম কুমার দাস তার স্ত্রীকে নিয়ে গর্ব করে বলেন, আমার স্ত্রী কেবল তার নিজের কথা ভেবে কাজ করছে না, সে পুরো সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করছে। সকলের ভালো চিন্তা করা মানুষটি আমার স্ত্রী, এটা আমার জন্য গর্বের বিষয়।
সনুরানীকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে পড়াশোনা করছেন বলে জানান দলিত নারী উন্নয়ন সংস্থার সদস্য স্নেহা দাস। তিনি বলেন, সনু দিদি আমাদের সমাজের সকল মেয়েদের জন্য আদর্শ। তাকে দেখিয়ে আমরাও আমাদের পরিবারকে বলতে পেরেছি, আরো পড়াশোনা করব। সনু দিদিকে দেখে আমরাও সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই।
সনু রানীর সংগঠন ঘিরে তার স্বপ্ন নিয়ে বলেন, আমি শিক্ষক হতে পারিনি। কিন্তু আমার ঘরেই এ সম্প্রদায়ের কিছু বাচ্চাদের আমি পড়াশোনা করাচ্ছি। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। এছাড়াও আমি মনে করি এ সম্প্রদায়ের নারীদের জাগ্রত করতে পারলে সে তার পরিবারের উন্নয়নে কাজ করতে পারবে।
আমাদের সম্প্রদায়ের নারীদের জীবন এ সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ। তারা হিন্দি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হওয়ায় তারা বাংলা ভাষী মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না। তবে এদের মধ্যে অনেকেই যথেষ্ট প্রতিভাবান। আমি চাই তাদের প্রতিভাকে উন্মোচন করতে। তাদের ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে চাই আমি। তারাও যেন দশজন মানুষের সঙ্গে সাহস নিয়ে কথা বলতে পারে, নিজের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হয়। দলিত সম্প্রদায়ের বিধায় এ এলাকার মানুষ অনেক সময় হেয় প্রতিপন্ন হয়।
আমাদের নতুন প্রজন্ম এতোটা প্রতিষ্ঠিত হবে আশা করি, যেন তাদের কেউ হেয় প্রতিপন্নতার শিকার না হতে হয়।
নারায়ণগঞ্জ জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা কর্মকর্তা ফারজানা কিবরিয়া দলিত সম্প্রদায়ের এ নারীর প্রসঙ্গে বলেন, দেশের সকল স্তরের নারীদের ন্যায় দলিত সম্প্রদায়ের নারীরা এগিয়ে যাবে সেই প্রচেষ্টা করে আমাদের সংস্থা। সনু রানীর এগিয়ে যাওয়াকে আমরা বাহবা জানাই এবং তাদের সম্প্রদায়ের অন্যান্য নারীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব।
সূত্র: বাসস