ক্ষতি হচ্ছে ফসলের, উর্বরতা হারাচ্ছে জমি অবৈধ ভাটায় ইট ও কাঠ পোড়ানোর মহোৎসব

চারঘাট প্রতিনিধি: ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, আবাসিক এলাকা এবং কৃষি জমিসহ পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। তবে এ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে ইটভাটা পরিচালনা করা হচ্ছে।
কৃষি জমির মাটি কেটে এনে তৈরি হচ্ছে ইট, পোড়ানো হচ্ছে গাছের কাঠ। অগ্রীম টাকা দাদনে দিয়ে করানো হচ্ছে শিশুশ্রম। এর পেছনে রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়সারা পদক্ষেপ। রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তর ও ইটভাটা মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী চারঘাট উপজেলায় ১০টি ইটভাটার মধ্যে মাত্র একটি ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে।
বাকি ভাটাগুলো চলছে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে। সুপার ব্রিকস নামে যে একটি ইটভাটার ছাড়পত্র রয়েছে সেটিও গড়ে উঠেছে ফসলি জমির মাঝখানে এবং জনবসতিপূর্ণ জায়গায়।
সরেজমিন চারঘাট উপজেলার বিভিন্ন ইট ভাটায় গিয়ে দেখা যায়, ভাটার অনুমোদন না থাকলেও উৎসবের মত ইট তৈরির কাজ করছেন প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক ভাটা শ্রমিকরা। রাতের আঁধারে অবৈধভাবে কৃষকের জমির মাটি কেটে ভাটাগুলোতে পাহাড় সমান উচু করে রাখা হয়েছে।
এ বছরের শুরুতে চারঘাটের এম জেড বি ব্রিকস, একতা ব্রিকস ও এম অ্যান্ড এন ব্রিকস ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা আদায় করলেও তারা পুনরায় ইট তৈরির কাজ শুরু করেছে।
ইট ভাটায় কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানোর কথা থাকলেও কয়লার দাম বাড়ার অযুহাতে অধিকাংশ ভাটায় কাঠ দিয়েই ইট পোড়ানো হচ্ছে। ভাটা সংশ্লিষ্টরা জানায়, একটি বড় ইটভাটায় একবারে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ ইট পোড়াতে ২২-২৫ দিন সময় লাগে। এ সময় কমপক্ষে ১১ হাজার মণ জ্বালানির প্রয়োজন হয়।
আবহাওয়া ভালো থাকলে এক মৌসুমে পাঁচ-ছয়বারে ৪৫-৫০ লাখ ইট পোড়ানো সম্ভব হয়। এ পরিমাণ ইট পোড়াতে ৬৫ থেকে ৬৭ হাজার মণ (প্রায় দুই হাজার ৭০০ মেট্রিক টন) জ্বালানি কাঠ পোড়াতে হয়।
চারঘাটের ঝিকরা এলাকার কৃষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, অনুপামপুর এলাকায় ফসলি জমিতে পাশাপাশি দুইটি ভাটা গড়ে উঠেছে। আমের মুকুল আসলেও ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে আম থাকেনা। বাধ্য হয়ে আম গাছ কেটে অন্য ফসল আবাদ করছি। সেই আম গাছের গুঁড়িও তারা কিনে ভাটায় পুড়িয়েছেন। অনেক ফসলও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না।
হলিদাগাছী এলাকার কৃষক সবুর আলী বলেন, ভাটা মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় তারা ক্ষুদ্র কৃষকদের অধিক টাকার প্রলোভন দেখিয়ে ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে রাতারাতি ফসলি জমির মাটি কেটে ভাটায় নিয়ে যাচ্ছে।
তাতে প্রতি বছরই ফসলি জমির পরিমাণ কমার পাশাপাশি জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ফসল উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও ভাটা কখনও বন্ধ হয় না।
চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন হাসান বলেন, ফসলি জমিতে ভাটা স্থাপনের নিয়ম না থাকলেও ভাটাগুলো পরিচালিত হচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের প্রধান অর্থকারী ফসল আমসহ সব ধরনের কৃষি আবাদ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
কৃষি জমির টপ সয়েল ইটভাটায় যাওয়ায় জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ইটভাটা মালিক বলেন, বছরের শুরুতে ভাটা মালিকদের মাঝে ভীতি তৈরি করতে পরিবেশ অধিদপ্তর দু একটি ভাটায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা করেছে। এরপর প্রতিটি ভাটা মালিকই পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেছে। এখন আর ভাটা চালাতে সমস্যা নেই।
চারঘাট উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি একরামুল হক টিপু বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দেয়া বন্ধ রেখেছে সেজন্য ভাটাগুলো ছাড়পত্র পাচ্ছেনা। কিন্তু ইটভাটাগুলো নিয়ম মেনে চলে। অধিকাংশ ভাটা কয়লায় চলে কিছু ভাটায় কাঠ পোড়ানো হয়। তবে সমিতির পক্ষ থেকে নিষেধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার চারঘাট উপজেলার সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, চারঘাট ও পুঠিয়ার অধিকাংশ ইটভাটা স্কুল-কলেজ, জনবসতি কিংবা ফসলি জমিতে। যে কয়টার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে সেগুলোও নিয়ম অনুযায়ী ছাড়পত্র পায় না। এসব ভাটায় শিশুশ্রমও হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে এসব বিষয়ে আন্দোলন চালিয়ে আসলেও লোক দেখানো দু একটা জরিমানা ছাড়া ফলাফল শূন্য। পরিবেশ অধিদপ্তর রাজশাহীর সহকারী পরিচালক মোঃ কবির হোসেন বলেন, চারঘাটের একটি ভাটার ছাড়পত্র রয়েছে। এছাড়া বাকিগুলো অবৈধভাবে চলছে। এ বিষয়ে আমরা একবার অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করেছি। খুব দ্রতই আবারও অভিযান চালানো হবে।