রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মহান শিক্ষক দিবস পালিত

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক: মঙ্গলবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মহান শিক্ষক দিবস পালিত হয়েছে। উনসত্তরের এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা প্রক্টরের দায়িত্ব পালনকালে পাকিস্তানি সেনাদের বেয়োনেট চার্জে নিহত হন। তিনিই এদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী।
দিবসের কর্মসূচিতে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সকাল ৯টায় উপাচার্য প্রফেসর সালেহ্ হাসান নকীব, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) প্রফেসর মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান, কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মতিয়ার রহমানসহ প্রশাসনের ঊর্ধতন কর্মকর্তাগণ শহীদ ড. জোহার সমাধি ও জোহা স্মৃতিফলকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও মোনাজাত করেন।
এরপর রসায়ন বিভাগ ও শহীদ শামসুজ্জোহা হলসহ অন্যান্য আবাসিক হল, বিভাগ, রাবি স্কুল ও শেখ রাসেল মডেল স্কুল, শিক্ষক সমিতি, অফিসার সমিতি এবং হল, বিভাগসহ অন্যান্য পেশাজীবী সমিতি ও ইউনিয়ন শহীদ জোহার সমাধি ও স্মৃতিফলকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। সকাল ১০টায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত হয় জোহা স্মারক বক্তৃতা। এতে ‘শিক্ষার বাহন অথবা গণতান্ত্রিক জনশিক্ষা নীতির গোড়ার কথা’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের উচ্চতর তত্ত্বজ্ঞান কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান।
এই আয়োজনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক উপাচার্য প্রফেসর সালেহ্ হাসান নকীব এবং পৃষ্ঠপোষক উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) প্রফেসর মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান, কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মতিয়ার রহমান এবং সম্মানিত অতিথি ছিলেন শহীদ ড. জোহার কন্যা সাবিনা জোহা খান। রসায়ন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া এতে সভাপতিত্ব করেন। সেখানে অন্যদের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ইমেরিটাস প্রফেসর এ কে এম আজহারুল ইসলাম শহীদ ড. জোহা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিক্ষক, কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
স্মারক বক্তা অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, বাংলাদেশে এখন যে শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান তাকে কোনো বিচারেই গণতান্ত্রিক বলা যায় না। বৈষম্যহীন তো নয়ই, এই ব্যবস্থাকে ‘জাতীয়’ বলা যায় কিনা, তাও তর্কসাপেক্ষ। এই ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ সার্বজনীনতার অভাব। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ক্রমবর্ধমান ধনসম্পদ বৈষম্যের ভিত্তিতে শিক্ষাদানের মধ্যেও বৈষম্যের প্রতিষ্ঠা।
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা কিংবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরও বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। এ দেশের বিরাজমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে তাই ‘আধা-ঔপনিবেশিক’ বললে বড় কোনো অন্যায় হয় না। ক্রমবর্ধমান ইংরেজি মাধ্যম আর ইংরেজি সংস্করণ শিক্ষার জয়জয়কারটা হিসাবে নিলেও এই সত্য প্রতীয়মান হয়।
অনুষ্ঠানে উপাচার্য বলেন, আসলে আনুষ্ঠানিক ভাবে জোহা স্মারক বক্তৃতা শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। আজ এই বক্তৃতা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বহুদিন ধরেই ১৮ ফেব্রুয়ারি আমরা শিক্ষক দিবস পালন করে আসছি। দিবসটি পালন করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, আমাদের মধ্যে অনেক কৃতি মানুষ আছেন, অনেক মহান মানুষ আছেন, কিন্তু আমরা তাঁদেরকে ধারণ করতে গিয়ে সময়ে সময়ে সংকীর্ণতায় পৌঁছাই।
ড. জোহার মধ্যে ছিল ভীষণ যোগ্যতা, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সর্বোপরি অমিত সম্ভাবনা। আমি বলতে পারি, তাঁর এই গুণগুলো বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহান মানুষ আমাদের মধ্যেই আছেন, কিন্তু আমরা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের কুক্ষিগত করার চেষ্টা করি। এতে করে না তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, না যেভাবে ধারণ করতে চাই তা পারি। আজকের ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা যেন সেই সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারি।
সাবিনা জোহা খান তাঁর বক্তৃতায় বলেন, এখানে আমার স্মৃতিচারণ করার মতো তেমন কিছু নেই, তবে একটা কথা বলতে হবে, আমি মানুষের মতো মানুষ হয়েছি, এটার কৃতিত্ব আপনাদের। আমার চলাফেরা, আচার-আচরনে আমি যোগ্য হিসেবে গড়ে উঠেছি কিনা, এটার বিচারক আপনারা। এখন আমি ফিরে আসছি এই কারণে যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার আব্বার একটা বন্ধন, যেটা চির অটুট। আমার আব্বা আপনাদের মাঝেই শুয়ে আছেন। আমি যেখানেই যাই, আমার এই বন্ধন কমবে না। বারবার এখানে ফিরে আসতে হবে।
প্রসঙ্গত, দিবসের কর্মসূচিতে আরও ছিল বাদ জোহর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআনখানি ও বিশেষ মোনাজাত, বাদ আসর শহীদ শামসুজ্জোহা হলে দোয়া মাহফিল। এছাড়া সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বরে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এ দিন শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য খোলা ছিল। এদিন রাবি শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় শহীদ ড. শামসুজ্জোহা কর্ণার উদ্বোধন করেন শহীদের কন্যা সাবিনা জোহা খান।
এদিকে শহীদ ড. শামসুজ্জোহার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। শহীদ জোহার সমাধি ও স্মৃতিফলকে পুস্পস্তবক অর্পণ ও আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনুসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
কর্মসূচি পালন করে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু সাংবাদিকদের বলেন, শহীদ শামসুজ্জোহা আজকের এইদিনে রক্তাক্ত বুলেট নিজের বুকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। এটা আমাদের রাজশাহীর জন্য গর্বের বিষয়। তিনি আমাদেরকে যে শিক্ষা দিয়েছেন তারই ধারাবাহিকতায় গত আগস্টে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে এই দেশে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ঘটেছে। ছাত্রদের নতুন দলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের নতুন দল সম্পর্কে ছাত্ররাই ভালো জানেন। আমাদের যুদ্ধ শুধু ভারতের বিরুদ্ধে।
কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করেছি। এই রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাকে ৬৯ এ নিজের জীবন দিয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা। তার চেতনাকেই ধারণ করেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আজকের এই দিনে আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তার পরিবারের জীবিতদের প্রতি জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে সম্মান জানাচ্ছি। এ সময় কর্মসূচি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম, শাখা ছাত্রদল ও মহানগর বিএনপির প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।