বাঘায় শুরু হয়েছে খেজুরের রসের পিঠা উৎসব
লালন উদ্দীন, বাঘা থেকে: রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় শুরু হয়েছে মিষ্টি খেজুর গুড় ও রসের পিঠা উৎসব। গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবুক্ষ খেজুর গাছ শীত এগিয়ে আসছে। সেই সঙ্গে অযত্ন ও অবহেলায় বেড়ে ওঠা খেজুর গাছ সুমিষ্ট রস দিচ্ছে। রস থেকে তৈরি হচ্ছে গুড়। যার স্বাদ ও ঘ্রাণ দুই-ই-সু মধুর। শুধু যে গুড়ই তৈরি হচ্ছে তাও নয়। এই শীতকে ঘিরে গ্রামঞ্চলে শুরু হয়েছে শীতের পিঠাপুলি আর পায়েস খাওয়ার উৎসব।
উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলার ২টি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নে ৩০ হাজার কৃষি পরিবার রয়েছে। যাদের প্রত্যেকেরই কম-বেশি খেজুর গাছ রয়েছে। সব মিলিয়ে ৩ হাজার খেজুর বাগান রয়েছে। এ ছাড়া সড়কপথ, রেললাইনের ধার, পতিত জমি, জমির আইল ও বাড়ির আঙিনায় রয়েছে আরও হাজার হাজার খেজুর গাছ। সস্পতি গুড়ের ভালো দাম দেখে বর্তমানে পদ্মার চরাঞ্চলের কৃষকরাও এখন খেজুর বাগান তৈরি করছেন। এর ফলে চাঙ্গা হবে গ্রামীণ অর্থনীতি।
বাঘা পৌর এলাকার কলিকগ্রাম এলাকার গাছি হাসমত গান জানান, একজন গাছি প্রতিদিন ৫০-৬০ টি খেজুর গাছের রস আহরণ করতে পারে। এ রকম হাজার-হাজার গাছি রয়েছে যারা শীত মৌসুমে খেজুরের রস সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সময় কাটান। যারা খেজুর গাছ লাগায় তাদের আঞ্চলিক ভাষায় গাছি বলা হয়। মৌসুম ভিত্তিক এই পরিবার গুলো খেজুর গাছের ওপর নির্ভরশীল।
একজন গাছি এক মৌসুমে অর্থ্যাৎ ১২০ দিনে ১টি গাছ থেকে ২৫ থেকে ৩০ কেজি গুড় পেয়ে থাকেন। খেজুর গাছ ফসলের কোনো ক্ষতি করে না। এ গাছের জন্য বাড়তি কোনো খরচও করতে হয় না। ঝেঁপ-জঙ্গলে কোনো যত্ন ছাড়াই বড় হয়ে ওঠে খেজুর গাছ। শুধু মৌসুম এলেই নিয়মিত গাছ পরিষ্কার করে রস সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই রস দিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু গুড়।
অপর দিকে খেজুর গাছের পাতা দিয়ে মাদুর তৈরি করা হয়। পরিকল্পিত ভাবে খেজুর গাছ বৃদ্ধি করা হলে দেশে গুড়ের চাহিদা মেটানোর পরও বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে অনেকেই মন্তব্য করেন। বাঘার বাউসা গ্রামর গাছি ফারুক ও মহাসিন জানান, আমাদের নিজেস্ব খেজুর বাগান রয়েছে।
তবে অত্র অঞ্চল আম প্রধান এলাকা হওয়ায় ইতিমধ্যে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু খেজুর গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে। বাঘা পৌর এলাকার বাজুবাঘা গ্রামের আবু শ্যামা জানান, যাদের খেজুর গাছ নেই এ রকম অনেক মানুষ শীত মৌসুমে ৩ মাসের জন্য খেজুর গাছ ৪০০ টাকা, ভাল মানের গাছ হলে ৫০০ টাকায় চুক্তি নিয়ে রস সংগ্রহ করে থাকেন। এরপর শীত শেষে তারা শহরে গিয়ে বিভিন্ন কাজ-সহ রিকশা ও ভ্যান চালিয়ে সংসার পরিচালনা করেন।
এদিকে গড়গড়ি ইউনিয়নের খায়েরহাট গ্রামের গৃহিণী সাধীনা বেগমের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, আমার ৪ মেয়ে ও ১ ছেলে রয়েছে। এর মধ্যে ৩ মিয়েকে বিয়ে দিয়েছি। শীত এলেই জামাই- মেয়ে, নাতি- নাতনি, মেয়েদের শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্নীয়দের নিয়ে ২-১ বার খেজুর গুড়ের পিঠা-পায়েস উৎসবের আয়োজন করি।
এ প্রথাটা আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমল থেকে চলে আসছে। তাই আমিও করি। তিনি আরো বলেন, আমাদের নিজে ৬০ টি খেজুর গাছ রয়েছে। এ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে নিজেরা খাই। আবার গুড় বিক্রয় করে যে টাকা পাই তা সংসারে কাজে লাগাই।
বাঘার বাজুবাঘা ইউনিয়নের জোতরাঘোব গ্রামের কৃষক ফজলুর রহমান বলেন, আর কয়েকদিন বাদেই একটু বেশি শীত শুরু হলে পুরোদমে রস সংগ্রহ করা হবে। তখন গ্রামে গ্রামে শীতের সন্ধ্যায় সাজো রস খাবে অনেকে। শহর গ্রামের লোকজন অনেক সময় এই টাটকা রস খেতে গ্রামে ছুটে আসেন। তিনি বলেন, বর্তমানে বাজারে গুড় উঠেছে। তবে তীব্র শীত না নামায় এখনও পুরোদমে রস নামেনি। এদিকে থেকে গুড়ের বাজার বর্তমানে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকার মধ্যে কেনা-বেচা চলছে।
তবে তীব্র শীত নামলে গুড়ের বাজার মূল্য কমে আসবে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, আমরা কৃষকদের মাঝে খেজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দিচ্ছি। এ ছাড়া আখের পাতা ও ধানের খড় সংগ্রহ করার পরামর্শ দিয়ে থাকি, যা গুড় তৈরিতে সহজ হয়।
তিনি আরও বলেন, বাঘার মানুষ একমাত্র খেজুর গাছ থেকে প্রতি মৌসুমে প্রায় ৭-৮ কোটি টাকা আয় করে থাকেন। তাঁর মতে, যদি কৃষকরা নিজ নিজ পতিত জমিতে খেজুর গাছ রোপণ করেন, তাহলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে ব্যাপক অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হবে।