ঢাকা | জানুয়ারী ৯, ২০২৫ - ১:১৩ অপরাহ্ন

এক বছরের কাজ শেষ হয়নি আড়াই বছরেও

  • আপডেট: Wednesday, January 8, 2025 - 5:00 pm

চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

চারঘাট প্রতিনিধি: রাজশাহীর চারঘাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ১০০ শয্যায় রূপান্তর করার জন্য ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনতলা ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২২ সালের ২২ মে। নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ শুরুর পরবর্তী এক বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ২৩ মে’র মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও আড়াই বছরেও কাজ বুঝে পায়নি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালে এক্সরে, ইসিজি ও সনোরোজিস্ট মেশিনসহ যাবতীয় সরঞ্জাম থাকলেও ভবন সঙ্কটের কারণে দীর্ঘদীন ধরে এসব সেবা বন্ধ হয়ে আছে। দীর্ঘসময় ব্যবহার না হওয়ায় মেশিনগুলোও এখন নষ্ট হবার উপক্রম। সবমিলিয়ে একদিকে যেমন চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে, অপরদিকে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগী ও চিকিৎসকরা।

গত সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় সরেজমিন চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে উচ্চ রক্তচাপের রোগী নজরুল ইসলামকে হাসপাতালের বর্হিবিভাগের এনসিডি কর্নারের সামনে বসে থাকতে দেখা যায়। তিনি এসেছেন চিকিৎসক দেখাতে ও ওষুধ নেয়ার জন্য। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় এসে প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে গেছি। পুরো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খুঁজেও ডাক্তার-ওষুধ কিছুই পাইনি। গত (সোমবার) আমিসহ অনেক রোগী এসে অপেক্ষা করছি। ৯ টায় ডাক্তার বসার কথা থাকলেও সকল ডাক্তারের রুম তালাবদ্ধ। একই অভিযোগ করলেন সানোয়ারা বেগম, মর্জিনা খাতুনসহ অনেক রোগী।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তিন বছর আগে ৩১ শয্যার রাজশাহীর চারঘাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ১০০ শয্যায় রূপান্তর করা হয়। ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতালের তিন তলা ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২২ সালের ২২ মে। নতুন ভবন নির্মাণ করতে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট পুরনো দ্বিতল ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ শুরুর পরবর্তী এক বছরের (২০২৩ সালের ২২ মে) মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এক বছরের কাজ আড়াই বছরেও বুঝে পায়নি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ।

এদিকে ভবন সঙ্কটের পাশাপাশি চিকিৎসক ও কর্মচারী সঙ্কটে হাসপাতালের সেবার কার্যক্রম আরও বেশি ভেঙে পড়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ছয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত চারঘাট উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষের চিকিৎসার প্রধান অবলম্বন এই হাসপাতাল। এই হাসপাতালে ৩১ চিকিৎসক পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৭ জন, শূন্য আছে ২৪ চিকিৎসকের পদ। পাঁচজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র একজন, আয়ার দুইটি পদও শূন্য। প্রায় এক বছর ধরে মেডিসিন, কার্ডিওলোজি, অর্থপেডিক্স, সার্জারি, ইএনটি, অপথালমোলজি ও সার্জারি বিভাগে চিকিৎসক নেই।

এছাড়া দেখা যায়, পুরনো তিনতলা ভবনের নিচতলা হাসপাতালে বর্হিবিভাগ ও জরুরি বিভাগ হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। ছোট ছোট রুমে চিকিৎসকরা রোগী দেখছেন। প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪৫০ জন রোগী গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে চিকিৎসক সঙ্কটে অধিকাংশ রোগী হাসপাতালে ঘুরে ক্লিনিকে যাচ্ছেন চিকিৎসা নিতে। ছোট্ট একটি রুমে প্যাথোলজির পরীক্ষার কাজ চলছে। এক্স-রে ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন স্থাপনের জায়গা না থাকায় টেকনোলজিস্টরা পরীক্ষার কাজ বাদ দিয়ে টিকেট বিক্রি করছেন। একই ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় গাদাগাদি করে ভর্তি রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার ভায়ালক্ষীপুর এলাকার আলতাফ হোসেন বলেন, পেটে অসহ্য ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলাম। কিন্তু মেডিসিন বিশেষজ্ঞ নেই, কাকে দেখাবো? শিশু বিশেষজ্ঞ ছাড়া কোনো চিকিৎসক নেই। এজন্য অপেক্ষা করে ফেরত যাচ্ছি। এখন রাজশাহী শহরে যেকোন ক্লিনিকে ডাক্তার দেখানো ছাড়া উপায় নেই। হাজার টাকা ভিজিট দিয়ে রোগী দেখানো আমার মত ভ্যান চালকের পক্ষে অসম্ভব।

রাওথা এলাকার বাসিন্দা রুনা বেগম বলেন, আমার ছেলে গাছ থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে। হাসপাতালে এসে দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর জানলাম এখানে অর্থপেডিক্সের কোনো চিকিৎসক নেই। চিকিৎসক না পেয়ে একজন উপ-সহকারী ডাক্তারকে দেখানোর পর তিনি এক্স-রে পরীক্ষা দিয়েছেন। হাসপাতালে পরীক্ষাও হয় না। বাইরে ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছি পরীক্ষা করানোর জন্য। চিকিৎসক নেই, পরীক্ষা নেই, হাসপাতাল বন্ধ রাখা উচিত।

হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগের টেকনোলজিষ্ট আবু তাহের বলেন, গত দুই বছর ধরে এক্স-রে ও আল্টাসনোগ্রাফি বন্ধ। মেশিন থাকলেও ভবনের সঙ্কটের কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছিনা। শুয়ে বসে দিন কাটছে কিন্তু রোগীদের সেবা দিতে পারছিনা। নবনির্মিত তিনতলা ভবনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট প্রকৌশলী পিযুষ মন্ডল বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতায় কাজ শেষ হতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ। কয়েকদিনের মধ্যেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের চারঘাট উপজেলার সভাপতি কামরুজ্জামান বলেন, সারাদেশের মধ্যে সেবা প্রদানে কয়েকবার দেশসেরা হয়েছে চারঘাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অথচ নানা সঙ্কট ও অবহেলায়-অনাদরে সেই হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা আজ বন্ধের পথে। বার বার বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মিলছে না।

চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌফিক রেজা বলেন, চিকিৎসক ও ভবন সঙ্কটের কারণে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নতুন ভবন বুঝে পেলেও সেখানে কাজ শুরু হতে কিছুটা বিলম্ব হবে। কারণ সেখানে কোনো আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। চিকিৎসক ও যাবতীয় সরঞ্জামের আবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।