ঢাকা | সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪ - ১০:৫৬ অপরাহ্ন

উজানে বৃষ্টি: আবারও চোখ রাঙাচ্ছে পদ্মা

  • আপডেট: Tuesday, September 24, 2024 - 10:49 pm

জগদীশ রবিদাস: ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানিতে গত কয়েকদিনে ফের বাড়তে শুরু করেছে রাজশাহীর পদ্মার পানি। এর আগে গত আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে পদ্মায় পানি বাড়লেও শেষের দিকে তা কমতে শুরু করে।

তবে সম্প্রতি ফের পানি বাড়তে শুরু করায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন পদ্মার তীরবর্তী মানুষ। যদিও রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে; আরও দু’একদিন পর্যন্ত পদ্মায় পানি বৃদ্ধি পাবে। পরে তা স্থিতিশীল হয়ে আবারও কমতে শুরু করবে। এতে এই অঞ্চলে বন্যা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তারা।

এদিকে, গত পদ্মা, মহানন্দা ও পুনর্ভবা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২ উপজেলার ১০ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের ১ হাজার ৫ শ ৫৯ হেক্টর জমির ফসল জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। সেই সাথে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার পদ্মা নদীর তীরবর্তী ১০ ইউনিয়নের ২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

শহরের বড়কুঠি পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানির উচ্চতা পরিমাপ করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ রিডার এনামুল হক। তিনি সোনালী সংবাদকে জানান, বড়কুঠি পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। মঙ্গলবার এই পয়েন্টে পদ্মার পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৮৫ মিটার। অর্থাৎ বড়কুঠি পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপৎসীমার ১ দশমিক ৬৫ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এনামুল আরও জানান, আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে পদ্মায় পানি বাড়লেও শেষের দিকে তা কমতে শুরু করে। তবে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবারও পানি বাড়তে শুরু করে পদ্মায়। কয়েকদিন বৃদ্ধি পেয়ে পানি আবারও স্থিতিশীল হয়। পরে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে পানি বাড়তে শুরু করে এ পর্যন্ত চলমান আছে।

তার দেয়া তথ্যমতে, গত ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টায় পদ্মার পানির উচ্চতা ছিল ১৫ দশমিক ৩০ মিটার। পরেরদিন ১৬ সেপ্টেম্বর তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৩১ মিটারে। ১৭ সেপ্টেম্বর পানির উচ্চতা ছিল ১৫ দশমিক ৩২ মিটার। ১৮ সেপ্টেম্বর পানির উচ্চতা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৪৮ মিটারে। ১৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টায় ০ দশমিক ২৫ মিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৭৩ মিটারে। ২০ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টায় পানির উচ্চতা ছিল ১৬ মিটারে।

একদিনের মাথায় পানি বেড়ে ২১ সেপ্টেম্বর দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ২৩ মিটারে। ২২ সেপ্টম্বর পানির উচ্চতা পাওয়া যায় ১৬ দশমিক ৪৫ মিটার। ২৩ সেপ্টেম্বর পানির উচ্চতা দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৬৫ মিটার। সবশেষ গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টায় পানির উচ্চতা পাওয়া যায় ১৬ দশমিক ৭৬ মিটার। আর সন্ধ্যা ৬টায় একই পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৮৫ মিটার। বিশ্লেষন করে দেখা যায়, ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টা থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত পদ্মার বড়কুঠি পয়েন্টে পানি বেড়েছে ১ দশকি ৫৫ মিটার। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে পদ্মার পানি বিপৎসীমার ১ দশমিক ৬৫ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

আর আগে ভারতের বিহারের গঙ্গায় পানির স্তর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা ব্যারেজের ১০৯টি গেটের সবগুলো খুলে দেয়া হয়। ফারাক্কা ব্যারেজে ওই সময়ে পানির স্তর বিপৎসীমা (৭২ ফুট) ছাড়ায়। তখন সেখানে পানির উচ্চতা ৭৬ ফুট ছিল বলে জানানো হয়। তবে ফারাক্কার সব গেট খোলার কারণে এ পর্যন্ত রাজশাহী অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

এদিকে ফের পদ্মা নদীর পানি বাড়ায় নদী তীরবর্তী মানুষ অসময়ে বন্যার আশঙ্কা করছেন। পানি বাড়ায় সম্প্রতি পদ্মার বুকে জেগে ওঠা চরগুলো ডুবে যায় পানির নিচে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী, পবা ও বাঘা উপজেলায় পদ্মা নদীর চরগুলোতে পানি বৃদ্ধির ফলে চরে চাষ করা নানান ফসল তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর ইউনিয়নের ১৫টি চরের হাজারো পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। তলিয়ে গেছে শত শত বিঘা জমির ফসল। বাঘার মানিকের চরে পানিতে তলিয়ে যায় অর্ধশত চাষির ফসল। এমন অবস্থায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা।

মানিকের চর এলাকায় চাষী বাবুল শেখ জানান, চরে তিনি ৬ বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেছিলেন। এর মধ্যে তিন বিঘার বাদাম উঠাতে পারলেও আরো তিন বিঘা বাদাম উঠানোর আগেই তা সম্প্রতি পানিতে ডুবে যায়। ফলে ফসলি খেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এই অবস্থায় বাদাম তুলে নেয়া হচ্ছে। নতুবা আর পাওয়া যাবে না।

পানি বৃদ্ধির কারণ বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অঙ্কুর সোনালী সংবাদকে বলেন, মূলত ফারাক্কার উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে পদ্মায় আবারও পানি বাড়তে শুরু করেছে। আকস্মিক বন্যার সম্ভবনা আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আগামী দু’একদিন পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থেকে আবারও তা স্থিতিশীল হবে। পদ্মার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করার কোন সম্ভবনা নেই। ফলে এই অঞ্চলে আকস্মিক কোনো বন্যা হবে না।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ব্যুরো জানায়, বন্যায় কবলিত নিম্নাঞ্চল ইউনিয়ন হলো, সদর উপজেলার আলাতুলি, নারায়নপুর, শাহজাহানপুর ও চরবাগডাঙ্গা, শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর, পাঁকা, দুলর্ভপুর, ঘোড়াপাখিয়া ও মনাকষা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব বলেন, উজানের ঢলে গত সপ্তাহ ধরে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১১ সেন্টিমিটার পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পদ্মায় পানি বিপদসীমা ধরা হয়েছে ২২ দশমিক ০৫ মিটার। বর্তমানে পদ্মার পানি বিপদসীমার মাত্র ৮০ সেন্টিমিটার নিচ নিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে, কয়েক দিনের মধ্যে নদীর পানি কমতে শুরু করবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. পলাশ সরকার জানান, পদ্মার পানি বৃদ্ধির কারণে শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা, উজিরপুর, দুর্লভপুর ও সদর উপজেলার নারায়ণপুর, আলাতুলী, শাহাজাহানপুর, চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের ১ হাজার ৫শ’ ৫৯ হেক্টর মাসকালাই, রোপা আউশসহ সবজি পানি নিচে ডুবে গেছে। ডুবে যাওয়া মাসকালাইয়ের মধ্যে রয়েছে শিবগঞ্জ উপজেলার ১ হাজার ২৫০ হেক্টর ও সদর উপজেলায় ২১২ হেক্টর। তিনি আরও জানান, দুইটি উপজেলার প্রায় ৫ হাজার ৩১৫ জন কৃষকের মাসকালাই, আউশ ধান, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ, চিনা ও আখ ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নারায়ণপুর ইউনিয়নের সাদ্দাম হেসেন বলেন, ১০ থেকে ১৫ দিন আগে ১২ বিঘা জমিতে মাসকলাই বীজ ছিটিয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার সব জমির মাসকালাই জলমগ্ন হয়ে গেছে। এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর দারুল হোদা আলিম মাদ্রাসার শ্রেণিকক্ষে পানি প্রবেশ করায় ছাত্রদের পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজির হোসেন জানান, হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধির ফলে চরাঞ্চলের বিপুল পরিমাণ জমির মাসকালাই ডুবে যাওয়ায় নষ্ট হতে বসেছে। বেশি দামে মাসকালাই বীজ কিনে বপন করে তা ডুবে যাওয়া কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক জানান, শিবগঞ্জ উপজেলায় পাঁকা ইউনিয়নের ২ হাজার ৫’শ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর আল মনসুর শোয়াইব জানান, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি সভায় বন্যা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এরই মধ্যে বন্যা মোকাবেলায় যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন।