যে পরিকল্পনায় ফাহিম সালেহকে হত্যা করেন তার ব্যক্তিগত সহকারী
অনলাইন ডেস্ক: নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে নিজ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাও-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০২০ সালের ১৪ জুলাই তার লাশ উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় তার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী টায়রেস হাসপিল (২৫) দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।
সোমবার (২৬ জুন) নিউইয়র্কের ম্যানহাটন সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা হাসপিলকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন।
আদালতের এই রায়ের আগে হাসপিল দাবি করেছিলেন, ফরাসি প্রেমিকাকে খুশি করার জন্য দামি উপহার কেনার জন্য ফাহিমের টাকা চুরি করেন। চুরির কথা প্রকাশ পেলে প্রেমিকা তাকে ছেড়ে চলে যেত—তাই তিনি ফাহিমকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তবে বিচারকেরা তার এই দাবি খারিজ করে দিয়েছেন।
তবে কেন বিচারকেরা হাসপিলের দাবি খারিজ করে দিয়েছেন তা হত্যার দীর্ঘ পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ডের ধরনেই বোঝা যায়। হাসপিল কতটা শীতল রক্তের অধিকারী ছিলেন তা তার পরিকল্পনা ও হত্যার কায়দায় ফুটে উঠেছে। আদালতের রায়ের বিবরণীতে সেসব বিস্তারিত উল্লেক করা হয়েছে।
হত্যার পরিকল্পনা
টাইরেস হাসপিল ২০১৮ সালে ফাহিম সালেহের টাকা চুরি করার পরিকল্পনা শুরু করেন। কিন্তু ২০২০ সালের জুলাইয়ে এসে তার পরিকল্পনাটি হত্যার সিদ্ধান্তে রূপ নেয়।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসপিল ফরাসি প্রেমিকার জন্য দামি উপহার কেনার জন্য সালেহের কোম্পানি থেকে টাকা চুরি করেন।
হাসপিল টাকা চুরির জন্য একটি ভুয়া করপোরেট আইডি এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তৈরি করেছিলেন। তবে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সালেহ টাকা চুরির বিষয়টি বুঝতে পারেন। হাসপিল তখন চুরির টাকা পরিশোধে সম্মত হন। তবে পরে তিনি সেই অবস্থান থেকে সরে আসেন। একটি ভুয়া পেপ্যাল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ফাহিমের আরও টাকা চুরি করা শুরু করেন। এভাবে তিনি প্রায় ৪ লাখ মার্কিন ডলার চুরি করেন। একপর্যায়ে তিনি ফাহিমের সব টাকা নিয়ে বিলাসবহুল জীবনের আশায় তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
হাসপিল সোশ্যাল মিডিয়াতে সালেহের অবস্থানের ওপর নজরদারি শুরু করেন। হত্যাকাণ্ড গোপন করার জন্য কয়েক সপ্তাহ প্রযুক্তি, অস্ত্র, টেজার এবং রক্ত পরিষ্কার নিয়ে গবেষণা করেন। পরিচয় গোপন করার জন্য বিশেষ ধরনের পোশাক কেনেন, যাতে সালেহ তাঁকে চিনতে না পারেন।
অন্তত তিনটি পৃথক অনুষ্ঠানে জনাব সালেহকে হত্যার পরিকল্পনা করে হাসপিল। ২০২০ সালের মার্চে নাইজেরিয়ার লাগোসে সে ছুরি নিয়ে সালেহর পিছু নিয়েছিল। তবে হত্যা করেনি। এরপর নিউইয়র্কে ফিরে সালেহকে দুইবার হোপওয়েল জংশনেও পিছু নেন। সালেহর বাড়ি পুড়িয়ে ফেলার বা দৌড়ানোর সময় তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম হত্যায় ব্যক্তিগত সহকারী দোষী সাব্যস্তপাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম হত্যায় ব্যক্তিগত সহকারী দোষী সাব্যস্ত
২০২০ সালের মে মাসে হাসপিল সালেহকে তাঁর বাড়িতে হত্যা করবেন বলে ঠিক করেন। তিনি ঘাড়ে ছুরিকাঘাতে নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৭ জুন হাসপিল হোম ডিপো ঠিকাদার ব্যাগ, একটি সুইফার ওয়েটজেট এবং একটি করাত কেনেন।
হাসপিল সালেহের বাসা থেকে রাস্তার অপর পার্শ্বের বিল্ডিংয়ে একটি খালি অ্যাপার্টমেন্টের কৌশলে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি এমনভাবে নেস্ট ক্যামেরা বসান যাতে সালেহের বিল্ডিংয়ের যাবতীয় কিছু নজরদারি করা যায়।
হত্যাকাণ্ডের আগের দিনগুলোতে হাসপিল জাঁকজমকপূর্ণভাবে প্রেমিকার জন্মদিন পালন ও তাকে উপহার দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। তিনি পার্টি বেলুন, বড় কেক, বিলাসবহুল হ্যান্ডব্যাগ, জুতা, প্রাইভেট ইয়ট ট্যুর এবং চুরি করা টাকা দিয়ে সোহোতে একটি বিলাসবহুল এয়ানবিএনবি ভাড়া নেন।
হত্যাকাণ্ড
২০২০ সালের ১৩ জুলাই হাসপিল প্লাস্টিকের হেলমেট, বেসবল ক্যাপ এবং সানগ্লাস পরে সালেহের সঙ্গে তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের লিফটে প্রবেশ করেন। এ সময় বেচারা সালেহ হাসপিলের এমন পোশাক দেখে কোভিড সতর্কতা নিয়ে তাঁর সঙ্গে রসিকতা করেছিলেন। তবে লিফটের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই হাসপিল আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন।
হাসপিল প্রথমে পেছন থেকে ফাহিম সালেহকে টেজার মেশিনের শক দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলেন। এরপর তার ঘাড়ে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করতে থাকেন।
হত্যাকাণ্ড গোপন করতে হাসপিল মিনি ভ্যাকুয়াম মেশিন দিয়ে অ্যান্টি-ফেলন আইডেন্টিফিকেশন ডিস্ক (এএফআইডি) শূন্য করে ফেলেন। কেননা ওই ডিস্কে একটি সিরিয়াল নম্বর থাকে যা অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারে।
এরপর আনুমানিক বেলা ৩টায় হাসপিল অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে একটি উবারে করে নিউজার্সিতে যান। হাডসন নদীর জল কতটা গভীর ও সেখানে কীভাবে আলামত ডুবিয়ে দেওয়া যেতে পারে—তা নিয়ে তিনি আগেই গবেষণা করেন। ওই নদীতে তিনি পরের দিন একটি আবর্জনার ক্যানে অনেক আলামত ফেলে দেন।
হাসপিল পরের দিন ১৪ জুলাই সালেহর মরদেহ টুকরো টুকরো করতে এবং ঘটনাস্থল পরিষ্কার করতে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসেন। তারপরে তিনি করাত দিয়ে সালেহের শরীরকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেন এবং সেগুলো আগেই কিনে রাখা ব্যাগে ভরেন। এ সময় করাতের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেলে তিনি চার্জার কিনতে চলে যান।
হাসপিল যখন বাইরে যান তখন সালেহর কাজিন তাকে দেখতে এসেছিল কারণ বিগত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর কোনো সাড়া পায়নি। এ সময় তিনি অ্যাপার্টমেন্টে চাচাতো ভাইয়ের টুকরো টুকরো এবং শিরশ্ছেদ করা দেহ আবিষ্কার করেন এবং পুলিশকে ডাকেন।
এদিকে হোম ডিপো থেকে ফিরে আসার পর হাসপিল সালেহের অ্যাপার্টমেন্টে পুলিশের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন এবং প্রেমিকার জন্মদিনের উদ্দেশ্যে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
হত্যার পরের দিনগুলোতে হাসপিল ‘খণ্ডিত দেহ’, ‘ফাহিম সালেহ’ এবং ‘নিউইয়র্কে টেক সিইওর হত্যা’ লিখে ওয়েব সার্চ করেন। এবং গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত হাসপিল সালেহর পেপাল থেকে টাকা আত্মসাৎ করতে থাকেন।