অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইওভারে ছেয়ে যাচ্ছে রাজশাহী!
অনলাইন ডেস্ক: ৯৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজশাহী মহানগরীতে নির্মিত হচ্ছে ৮টি ফ্লাইওভার! এর মধ্যে নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে তিনটির। যার দুইটি রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্মাণ করেছে। আরেকটি নির্মাণ করেছে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)।
তিনটি ফ্লাইওভারই নির্মাণ করা হয়েছে শহরের পূর্বপ্রান্তে, যেখানে ফ্লাইওভার ব্যবহার হচ্ছে না বললেই চলে। এর মধ্যেই নতুন করে রাজশাহী সিটি করপোরেশন আরো পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এগুলোর প্রয়োজন আসলে কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নগরবাসী এবং বিশেষজ্ঞরা।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ‘সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে’ ২০১৯ সালে সরকার একনেকের মাধ্যমে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে সরকারি বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ২১ জুন অনুষ্ঠিত রাসিক নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এই প্রকল্পের মাত্র ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সমর্থ হয় সিটি করপোরেশন। ফলে এই প্রকল্পের প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার দরপত্র প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী সিটি করপোরেশন সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ফ্লাইওভারগুলো নির্মাণ করছে। সরকারি বার্তা সংস্থা (বাসস) এর তথ্যমতে, ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য সিটি করপোরেশন ৮২১ দশমিক ৯৩ কোটি টাকার সংস্থান করেছে। অর্থাৎ টাকার অঙ্কে রাজশাহী মহানগরীর সব থেকে বড় উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বরাদ্দই ব্যবহৃত হচ্ছে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজে।
‘সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পের অধীন তিনটি প্যাকেজে পাঁচটি ফ্লাইওভার ও ১৯টি অবকাঠামো নির্মাণ করবে। চুক্তি অনুযায়ী নগরীর হড়গ্রাম নতুনপাড়া রেলওয়ে ক্রসিংয়ে ৪০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। কোর্ট স্টেশন রেলওয়ে ক্রসিংয়ে ৫২১ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
শহিদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান চত্বর রেলক্রসিংয়ে ৮৯৭ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। ভদ্রা রেলক্রসিং ৫২০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ফ্লাইওভার নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। মহানগরীর বর্ণালী সংলগ্ন বন্ধ গেইট এবং নতুন বিলসিমলা রেলক্রসিং পর্যন্ত ১২৫৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ সমন্বিত ফ্লাইওভার নির্মাণে নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
রাসিকের যুক্তি: প্রকল্প পরিচালক ও রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর ইসলাম এ ব্যাপারে বলেন, নগরীতে আরো পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মিত হলে ট্রেন পারাপারের জন্য মহানগরীর কোথাও মূল সড়কে যানবাহনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। ফলে সড়কে যানজটও হবে না। এছাড়া শহরের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পাবে।
শহরে এতগুলো ফ্লাইওভার নির্মাণের ‘প্রয়োজনীয়তা’ আসলেই আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এগুলো দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনা থেকে তৈরি করা হচ্ছে। এখনই হয়তো ফ্লাইওভারগুলোর প্রয়োজনীয়তা সেভাবে বোঝা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে নগরীতে যানবাহন বাড়লে এগুলো ভালো কাজ দেবে।’
গুরুত্বহীন পুরোনো তিন ফ্লাইওভার: রুয়েট ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যবর্তী স্থানে ২০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮১০ মিটার ফ্লাইওভারসহ ৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করেছে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)। এটি ছিল রাজশাহীর প্রথম ফ্লাইওভার। প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল শহরের মধ্যে যানবাহনের চাপ কমানো। যাতে শহরের মধ্যে রাজশাহী-ঢাকা হাইওয়ের বাসগুলো প্রবেশ না করে এই পথে চলাচল করে।
কিন্তু জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করার পর গত ১০ মাসে সড়কটির কাজলা রুয়েট চত্বর থেকে মেহেরচণ্ডী পর্যন্ত ফ্লাইওভারসহ ২ দশমিক ২৫ কিলোমিটার অংশটুকু ব্যবহার হয়নি বললেই চলে। অধিকাংশ যানবাহনই ভদ্রা মোড় হয়ে আগের পথেই চলাচল করছে। বার বার ঘোষণা দিয়েও সরানো হয়নি, শিরোইলে অবস্থিত ঢাকা বাসটার্মিনাল। এছাড়া পুরাতন বাসটার্মিনাল ও ভদ্রা মোড় হয়েই অধিকাংশ বাস কোচ চলাচল করছে। ফলে শিরোইল ও ভদ্রা এলাকায় সবসময়ই যানজট লেগেই থাকছে। অথচ নতুন সড়কসহ ফ্লাইওভারটি সারা দিন ফাঁকাই থাকছে। তবে তরুণ-তরুণীরা এই রাস্তা আর ফ্লাইওভারকে আড্ডাস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে।
নগরীর প্রথম চালু ফ্লাইওভারটি ২০২ দশমিক ৫০ মিটার। চার লেনের সড়কে প্রথমে ২৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই লেনের ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়। পরে ঐ ভুল শোধরাতে ৪০ কোটি ৭৯ লাখ ৬৮ হাজার ১২০ টাকা ব্যয়ে সমপরিমাণ দৈর্ঘ্যের আরেকটি দুই লেনের ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়। আরডিএর ফ্লাইওভারের তুলনায় এখানে যানবাহনের সংখ্যা কিছুটা বেশি হলেও শুধুমাত্র রেললাইনের ওপর দিয়ে যাবার জন্য ফ্লাইওভার বানানো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল (রুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. কামরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ ধরনের প্রকল্পের আর্থিক সম্ভাব্যতা নিরূপণ করতে হয়। আমি জানি না, সেগুলো হয়েছে কি না। অথবা হয়ে থাকলে সেখানে কী তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু আমরা বাস্তবে যে চিত্র দেখছি তা খুব সুখকর নয়। রুয়েটের পেছনের ফ্লাইওভারটা তো রীতিমতো হাস্যকর। এখানে সারা দিনে কয়টা গাড়ি চলে তা হাতে গোনা যায়। এ ধরনের প্রকল্প সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই না। এই নগর পরিকল্পনাবিদ মনে করেন, সংস্থাগুলো চাইলে এ ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে রুয়েটের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে বিশেষজ্ঞ মতামতও নিতে পারে।’
এদিকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নগরীর হরগ্রাম, কোর্ট, বিলসিমলা, বর্ণালীর মোড় ও গৌরহাঙ্গা শহিদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান চত্বরে বিভিন্ন এলাকায় পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করছে।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন রাজশাহী বিভাগীয় কমিটির সভাপতি আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, রাজশাহীর মতো শহরে এখনই এতগুলো ফ্লাইওভার প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যেমন কোর্ট আর হরগ্রামের রাস্তাটা তো চাঁপাইনবাগঞ্জে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না।
তিনি বলেন, অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইওভার প্রকল্পের অর্থব্যয়ের জন্যই নির্মাণ করা হচ্ছে। একই কাজ বহুবার করা হচ্ছে, সেটাও একই উদ্দেশ্যে। সরকারি অর্থ শুধু বরাদ্দের পাশাপাশি প্রকল্প জনবান্ধব ও উপযোগী কিনা যাচাই করাও জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন বলেও মনে করেন।
সোনালী/ সা