ঢাকা | এপ্রিল ৩০, ২০২৫ - ৬:৩০ অপরাহ্ন

শিরোনাম

বন্ধুর পথ পেরিয়ে ৩১ বছরে সোনালী সংবাদ

  • আপডেট: Friday, February 2, 2024 - 9:00 pm

॥ সোনালী রিপোর্ট ॥

৯৯৩ সালের কথা। রাজশাহীতে ভালো মানের কোন দৈনিক পত্রিকা তখন ছিল না। পিছিয়ে পড়া রাজশাহী থেকে সে সময় অফসেটে ছাপা একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সোনালী প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং’র তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ। রাজশাহীর প্রকাশনা জগতে সোনালী প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং-ই প্রথম অফসেট ছাপাখানা যার স্বপ্নদ্রষ্টাও অ্যাড. আব্দুস সামাদ, যিনি দৈনিক সোনালী সংবাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানও।

অবশেষে অ্যাড. আব্দুস সামাদ, বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জননেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলে হোসেন বাদশা (রাজশাহী সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বর্তমান বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক), রাজশাহী জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট শিল্পপতি মোহাম্মদ আলী সরকার এবং মো. লিয়াকত আলীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রাজশাহী থেকে প্রথম অফসেটে ছাপা দৈনিক পত্রিকা হিসেবে সোনালী সংবাদের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পাঠকের হাতে পৌঁছে সোনালী সংবাদ। অফসেটে ছাপা রাজশাহীর প্রথম দৈনিক পত্রিকা। ঝকঝকে ছাপায় সোনালী সংবাদ প্রথম দিনেই ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মো. লিয়াকত আলী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। একটানা কোন দৈনিকে এত দীর্ঘদিন সম্পাদকের দায়িত্ব পালনও একটি বিরল নজির হয়ে আছে। এছাড়া সোনালী সংবাদের নির্বাহী পরিচালক জননেতা ফজলে হোসেন বাদশা টানা তৃতীয় মেয়াদে রাজশাহী সদর আসনের এমপি নির্বাচিত হন ও তিনি তার ক্লিনম্যান ইমেজ ধরে রাখতে সামর্থ্য হন। রাজশাহীর উন্নয়নের তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর পত্রিকার চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার জেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

শুরুতে সোনালী প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং-এর কার্যালয় থেকেই পত্রিকার যাবতীয় কাজ করা হয়। তখন সেখানে নিয়মিত অফিস করতেন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক প্রয়াত ওয়াজেদ মাহমুদ, তৎকালীন বার্তা সম্পাদক ও পরবর্তীতে নির্বাহী সম্পাদক প্রয়াত মোলাজ্জেম হোসেন সাচ্চু, সিটি এডিটর প্রয়াত বুলবুল চৌধুরী, তৎকালীন স্টাফ রিপোর্টার ও পরবর্তীতে চিফ রিপোর্টার প্রয়াত তবিবুর রহমান মাসুম, তৎকালীন সম্পাদনা সহকারী ও বর্তমানে স্টাফ রিপোর্টার তৈয়বুর রহমানসহ আরও কয়েকজন। তখন পত্রিকার ঢাকা ব্যুরো’র দায়িত্ব দেয়া হয় সাংবাদিক গোলাম রহমান দুলুকে। একদম শুরুতে বা বলা যেতে পারে পত্রিকা মার্কেটে আসার আগে পত্রিকা প্রকাশে ভালো ভূমিকা রেখেছিলেন আহসানুর রহমান (বর্তমানে পরিচালক, সান ডায়াল কোচিং সেন্টার) ও হাসান মিল্লাত (বর্তমানে সোনার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক)।

১৯৯৪ সালের পয়লা মে সোনালী সংবাদের কার্যালয় নগরীর জামাল সুপার মার্কেটে স্থানান্তর করা হয়। মার্কেটের দোতলার একটি কক্ষ ভাড়া করে কার্যালয় করা হয়। সেখানে যোগ দেন পত্রিকার বিভিন্ন বিভাগের আরও কয়েকজন সহকর্মী। এদের মধ্যে তৎকালীন স্টাফ রিপোর্টার এ কে এম শহিদুল ইসলাম (বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মরত ছিলেন, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), উত্তম কুমার দাস (তখন রাবিতে অধ্যায়নরত), তৎকালীন সাব এডিটর ও বর্তমানে চিফ রিপোর্টার মোমিনুল ইসলাম বাবু, ফটোসাংবাদিক সালাহউদ্দিন, স্টাফ রিপোর্টার মেহেবুব আলম বর্ণ ও মাহবুব তুষার-এর নাম উল্লেখযোগ্য। মূলত প্রবীণ-নবীন এক ঝাঁক সংবাদকর্মীকে নিয়ে শুরু হয় সোনালী সংবাদের পথচলা।

এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি সোনালী সংবাদকে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই যোগ দেন তৎকালীন সাব এডিটর, পরে মফস্বল বার্তা সম্পাদক এবং বর্তমানে বার্তা সম্পাদক আবদুল করিম, ফটো সাংবাদিক শাহাদত হোসেন বাদশা (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী), আরও পরে যোগ দেন প্রয়াত বার্তা সম্পাদক আনোয়ারুল আলম ফটিকসহ অনেকেই। সাধারণ বিভাগের মধ্যে শুরু থেকে এখনও রয়েছেন আব্দুর রহমান। সব বিভাগেই আরও অনেকেই যোগ দেন এবং পত্রিকাকে এগিয়ে নিতে অবদান রেখে চলেছেন। পত্রিকা বিপণনের সুবিধার্থে পরবর্তীতে সোনালী সংবাদের কার্যালয় জামাল সুপার মার্কেট থেকে নগর ভবনের সামনের একটি ভাড়া বাড়িতে চলে যায়। পরে কুমারপাড়ায় সোনালী সংবাদের কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়। ২০১৮ সালের ঈদুল আজহার কয়েক দিন আগে পত্রিকার অফিস কুমারপাড়া থেকে রাণীবাজারে স্থানান্তরিত হয়। সেখান থেকে ২৮ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে বোয়ালিয়া থানার মোড়ে স্থানান্তর করা হয়।

আজ পত্রিকার ৩০ বর্ষপূর্তি ও একই সাথে ৩১ বছরে পদার্পণ। দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায় পত্রিকাটির চলার পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এ পর্যায়ে আসতে হয়েছে সোনালী সংবাদকে। পত্রিকা মিডিয়া লিস্ট হওয়ার পরেও অনেক দিন নিউজপ্রিন্টের সরকারি কোটা দেয়া হয়নি সোনালী সংবাদকে। এ নিয়ে অনেক দেন দরবার ও তদবির করা হয়। খবর প্রকাশ করা হয়। এমনকি প্রতীকী প্রতিবাদ স্বরূপ অনেক দিন সোনালী সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠার একটি কলামের অংশ বিশেষ ‘কালো’ রাখা হত। এছাড়াও দীর্ঘদিন সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত রাখা হয় সোনালী সংবাদকে। এতেও দমিয়ে রাখা যায়নি সোনালী সংবাদকে।

সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার কারণে পত্রিকাটি রাজশাহী অঞ্চলের শীর্ষ পত্রিকা ও গণমানুষের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে প্রগতিশীল ধারায় পত্রিকাটি এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। মৌলবাদ ও জক্সিগবাদ ইস্যুতেও সোনালী সংবাদ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ কারণে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী, অন্ধ মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের রোষানলে পড়তে হয়েছে সোনালী সংবাদকে। তাদের প্রধান টার্গেটই ছিল দৈনিক সোনালী সংবাদ ও এর সাথে সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে ’বাংলা ভাই‘ ইস্যুতে জক্সিগবাদের বিরুদ্ধে খুবই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে এই পত্রিকাটি।

এ কারণে একাধিকবার জীবননাশের হুমকি দেয়া হয় এই পত্রিকার নির্বাহী পরিচালক রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জননেতা ফজলে হোসেন বাদশা, সম্পাদক মো. লিয়াকত আলী, প্রয়াত প্রধান প্রতিবেদক মাহাতাব চৌধুরীসহ অন্যান্য সহকর্মীদেরকে। বাংলাভাই যেদিন মিছিল সহকারে নগরীতে এসেছিল সেদিন তাদের আক্রোশের প্রধান লক্ষই ছিল সোনালী সংবাদ কার্যালয় ও জননেতা ফজলে হোসেন বাদশা। ওইদিন প্রকাশ্য পথসভায় সোনালী সংবাদ ও জননেতা ফজলে হোসেন বাদশাকে হুমকি দেয়া হয়। সেদিন আশঙ্কা করা হয়েছিল সোনালী সংবাদে আক্রমণ করা হতে পারে। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা সেটি করতে পারেনি।

রাজশাহীর মত পিছিয়ে পড়া অঞ্চল থেকে একটি দৈনিক পত্রিকা অত্যন্ত সুনামের সাথে দীর্ঘ সময় টিকে থাকা এবং প্রচার সংখ্যা ও গুণগত মানের দিক থেকে শীর্ষে থাকা কম কথা নয়। এর পিছনে রয়েছে পত্রিকাটির সংবাদ পরিবেশনে সংশ্লিষ্টদের সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতা। এর কারণে পত্রিকাটি রাজশাহী অঞ্চলের গণ মানুষের মুখপত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

দেশের বাইরে থেকেও বিভিন্ন গেমসের নিউজ কভার করেছেন পত্রিকার প্রয়াত চিফ রিপোর্টার তবিবুর রহমান মাসুম। তিনি নেপালে অনুষ্ঠিত এস এ গেমস (২০১৯), ইন্দোনেসিয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমস (২০১৮), ভারতে অনুষ্ঠিত এস এ গেমস (২০১৬), চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমস (২০১০), থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ভলিবল বাছাইপর্ব (২০০৯), ভারতে অনুষ্ঠিত ইন্দো-বাংলাদেশ বাংলা গেমস (২০০৬) ও নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ গেমস (১৯৯৯)-এর নিউজ কভার করে দৈনিক সোনালী সংবাদে পরিবেশন করেন। আরও অনেকে অনেকভাবে পত্রিকায় অবদান রেখেছেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ পর্যায়ে এসেছে সোনালী সংবাদ।

দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সোনালী সংবাদ পেয়েছে পাঠককূল। পেয়েছে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। এটি সোনালী সংবাদের জন্যে বিরাট প্রাপ্তি। এত কিছুর পরেও আমরা আমাদের মাঝ থেকে হারিয়েছি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদকে, হারিয়েছি প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সম্পাদক ওয়াজেদ মাহমুদকে, নির্বাহী সম্পাদক মোলাজ্জেম হোসেন সাচ্চুকে, হারিয়েছি বার্তা সম্পাদক আনোয়ারুল আলম ফটিককে, অকালে হারিয়েছি চিফ রিপোর্টার মাহাতাব চৌধুরীকে, চিফ রিপোর্টার তবিবুর রহমান মাসুমকে, হারিয়েছি সিনিয়র সাব এডিটর আফতাব আহম্মেদকে, পত্রিকার ভোলাহাট প্রতিনিধি ও ইতিহাস অনুসন্ধানী লেখক সালাউদ্দিনকে, হারিয়েছি ধামইরহাট প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান বদুলকে, হারিয়েছি জীবননগর প্রতিনিধি ওলিউল ইসলামকে, হারিয়েছি বদলগাছী প্রতিনিধি মাহবুব আলমগীর, বিট পিয়ন চঞ্চল, অফিস পিওন টেকন ও নবিরকে। আজকের এই দিনে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি সোনালী সংবাদের নিয়মিত লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালেযর বাংলা বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক ড. অমৃতলাল বালা ও ড. সুজিত সরকারকে। পত্রিকার এ পর্যায়ে আসতে তাদের অবদান ভুলবার নয়। পত্রিকার ৩০ বছর পূর্তি ও ৩১ বছরে পদার্পণে তাদেরকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং প্রার্থনা করছি তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি।

করোনা মহামারি পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে এবারও দৈনিক সোনালী সংবাদ অনাড়ম্বর ঘরোয়া আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবে।

সোনালী/জগদীশ রবিদাস

Hi-performance fast WordPress hosting by FireVPS