ঢাকা | ডিসেম্বর ২১, ২০২৪ - ৬:৫৩ অপরাহ্ন

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে জাসদ আপসহীন

  • আপডেট: Thursday, November 2, 2023 - 3:00 am

মতামত  || জাসদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী 

আমাদের দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রিয় দেশবাসী এবং দলের অতীত ও বর্তমানের সর্বস্তরের উপদেষ্টা-নেতাকর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

সুমহান মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার লক্ষ্য সামনে রেখে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদের জন্ম হয়েছিল। বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনাকারী, সংগঠক ও রণাঙ্গনের সামনের কাতারের যোদ্ধারা গঠন করেছিলেন জাসদ। সে জন্য জাসদ শুধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল নয়; জাসদ মুক্তিযোদ্ধার দল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাসদের কাছে শুধু কোনো স্লোগান নয়; কোনো বায়বীয় আদর্শ নয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আজ পর্যন্ত জাসদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে দুর্নীতি, লুটপাট, দলবাজি ও দলীয়করণ থেকে মুক্তি, সুশাসন কায়েম; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, আরও গণতন্ত্র, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, জনগণের স্বশাসন; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে শোষণ ও বৈষম্য থেকে মুক্তি– সমাজতন্ত্র কায়েম।

সে জন্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে জাসদ আপসহীন। ক্ষমতায় একবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও মুক্তিযোদ্ধার দল বা জোট, আরেকবার রাজাকার ও তালেবানের দল বা জোট– স্বাধীন দেশে রাজনীতিতে এই ‘মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা’ চলতে পারে না। জাসদ মনে করে, বাংলাদেশের ক্ষমতায় ও ক্ষমতার বাইরে সর্বত্র থাকতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, স্বাধীনতা নিয়ে, বাংলাদেশের জনগণের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো দরকষাকষি চলতে পারে না।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও মুক্তিযোদ্ধার দলের মধ্যে অনৈক্যের ফলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী সামরিক-বেসামরিক, অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিস্ট শক্তি বাংলাদেশের সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি সবকিছুর সাম্প্রদায়িকীকরণ করেছে। নিজেদের অপকর্ম জায়েজ করতে ধর্মকে ব্যবহার করেছে; ভেদ-বিভেদ-বৈষম্য-সংঘাত-সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

সে জন্যই জাসদ সর্বগ্রাসী সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার অবসানের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে জাতীয় পুনর্জাগরণ সংঘটিত করার আহ্বান জানিয়েছে। উনিশ শতকে ঔপনিবেশিককালে বাঙালির প্রথম জাতীয় পুনর্জাগরণ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালের বাঙালির দ্বিতীয় জাতীয় পুনর্জাগরণের ধারাবাহিকতায় এবারের আশু তৃতীয় জাতীয় পুনর্জাগরণ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বাংলাদেশের জনগণের বেঁচে থাকা আর উন্নয়ন ও অগ্রগতির পূর্বশর্ত।

জাতীয় পুনর্জাগরণ সংঘটন যখন আবশ্যক তখন আবারও কোণঠাসা সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গিবাদীদের জোট শুধু ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে দেশে আগুন সন্ত্রাসে মেতে উঠেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাবনা হাজির না করে নির্বাচনের কথা বলে অসাংবিধানিক ও অনির্বাচিত সরকার কায়েমের ষড়যন্ত্র করছে। এমনকি বিদেশিদের সঙ্গে আঁতাত করেছে।

জাসদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রাক্কালে দেশবাসীকে এসব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবিলা করে শান্তি-উন্নয়ন-অগ্রগতির লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে মুক্তিযুদ্ধকালীন জাতীয় ঐক্যের মতো সুমহান ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। জাসদ জাতীয় ঐক্যের নামে মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকারের ঐক্যের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক্ষণে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন, কাজী আরেফ আহমেদ, কর্নেল (অব.) আবু তাহের বীরউত্তম, শামসুল আলম খান মিলনসহ দলের অগণিত শহীদকে। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি অগণিত সাথীকে, যারা আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার এবং পরিবার-শিক্ষা-পেশাজীবনে ক্ষতিগ্রস্ত।

জাসদের আপসহীন ধারার সংগ্রামে যারা তাল মেলাতে পারেননি, তাদের এককালীন অবদানকেও আমি গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি জাসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খান, প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা মেজর এমএ জলিল ও আ স ম আবদুর রব, বিধান কৃষ্ণ সেন, শাজাহান সিরাজ, মীর্জা সুলতান রাজা, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, আ ফ ম মাহবুবুল হকসহ সবাইকে। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি)-সহ তাদের সবাইকে, বিবিধ কারণে যারা সাংগঠনিক কাঠামো থেকে দূরে আছেন। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মুজিব বাহিনীর যারা জাসদ রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন তাদের ও রণাঙ্গনের সবাইকে। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের, যারা জাসদ রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন তাদের ও বাকিদের।

আমি দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলতে চাই, তারা সবাই যদি আজ দলে থাকতেন, তাদের কর্মী হিসেবেই আমি আজও দলে সক্রিয় থাকতাম। তারা তাদের দল ছেড়ে গেছেন; সে দলের কর্মীদের নিয়োজিত পাহারাদার হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করছি।

সাংগঠনিক কাঠামো থেকে দূরে থাকা ও অন্য দলে সক্রিয় সব নেতাকর্মীকে আমি আশ্বস্ত করতে চাই, যে লক্ষ্যে আপনারা দল গঠন করেছিলেন বা জাসদের রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন; দল এখনও সেই লক্ষ্যেই আছে। জাসদের দরজা আপনাদের জন্য খোলাই আছে। দলে ফেরত এসে আপনাদের দায়িত্ব বুঝে নিন, আমি আপনাদের পাশে থাকব।

আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানাতে চাই, একটি ‘সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন’ হিসেবে জাসদ দেশের সব শ্রম-কর্ম-পেশার মেহনতি জনতার নিজস্ব সংগঠন। জাসদের পতাকাতলে সমবেত হোন, নিজের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সংগঠিত হোন। বিঃদ্রঃ: লেখাটি সমকাল হতে সংগৃহীত

হাসানুল হক ইনু এমপি: জাসদের সভাপতি; সাবেক তথ্যমন্ত্রী, তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি